12.7 C
London
April 19, 2025
TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

এশিয়ার সেরা লুকানো সম্ভাবনা ও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বিপ্লব

বাংলাদেশ, ১৮ কোটি মানুষের দক্ষিণ এশীয় দেশ, আজ বৈপ্লবিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। বিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর একটি হিসেবে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ধারাবাহিকভাবে ভারতের চেয়ে বেশি এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে এটি বিশ্বের ২৫তম বৃহৎ অর্থনীতি হবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে — এর পেছনে রয়েছে যুব জনগোষ্ঠী, ক্রমবর্ধমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও দ্রুত নগরায়ণ।

পিটার ড্রাকার বলেছিলেন, “জনসংখ্যাতাত্ত্বিক প্রেক্ষাপটই ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করে।” যারা এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছেন, তারা এই জনসংখ্যাগত পরিবর্তনের সুবিধা নিতে পারছেন — আইএমএফ-এর হিসাব অনুযায়ী ২০২৬ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৭% এরও বেশি।

১৯৫৪ সালে, যখন বাংলাদেশ তখনো পূর্ব পাকিস্তান ছিল, আমার দাদু হামিদুর রহমান সিনহা একটি ওষুধ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন — অ্যাকমি ল্যাবরেটরিজ, যা আজ দেশের প্রাচীনতম এবং সফলতম ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিগুলোর একটি। যা ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তালিকাভুক্ত। তখনকার দিনে, বাজারে থাকা ৮০% ওষুধই ভেজাল এবং অনেকটাই ব্যয়বহুল আমদানি-নির্ভর ছিল।

তিনি দেশে বসেই মানসম্পন্ন ওষুধ সাশ্রয়ী দামে উৎপাদন শুরু করেন এবং সবসময় বলতেন, “ভোক্তাকে ঠকালে আমাদের ক্ষতি হবে।”

আজ, ফার্মাসিউটিক্যাল খাত বাংলাদেশের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল শিল্প, এবং এই অঞ্চলের অন্যতম গতিশীল খাত। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ৬ষ্ঠ বৃহত্তম ওষুধ উৎপাদক। স্থানীয়ভাবে ৯৮% চাহিদা পূরণ করে, ফলে প্রায় স্বনির্ভর একটি উদীয়মান অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের ওষুধ এখন ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৫০টিরও বেশি দেশে রপ্তানি হয়।

আমি যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম ও বড় হয়েছি। আন্তর্জাতিক আইন ও পররাষ্ট্রনীতিতে আইনজীবী হিসেবে সফল ক্যারিয়ারের পর, এক দশক আগে আমি পারিবারিক শিকড়ে ফিরে বাংলাদেশে পা রাখি এবং প্রতিষ্ঠা করি প্রাভা হেলথ। যদিও পরিবারিক ঐতিহ্য আমাকে স্বাস্থ্য উদ্যোক্তা হতে অনুপ্রাণিত করেছে, কিন্তু এর পেছনে রয়েছে একটি ব্যক্তিগত ঘটনা।

২০১১ সালে ঢাকায় পারিবারিক সফরে, আমার মায়ের একটি সাধারণ অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনে জটিলতা তৈরি হয় এবং তাকে বিদেশে গিয়ে আরও অপারেশন করাতে হয়। এই ঘটনা বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার গুণগত ঘাটতিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। একজন আমেরিকান প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত আইনজীবী হিসেবে আমি সিদ্ধান্ত নিই দেশে ফিরে এসে প্রাভা হেলথ গড়ে তোলার — যা হবে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান এবং মধ্যবিত্তের জন্য মানসম্মত, সাশ্রয়ী চিকিৎসা নিশ্চিত করবে।

মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত শ্রেণির প্রসারে উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবার চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। ২০১০ সাল থেকে স্বাস্থ্যখাতের বার্ষিক গড় প্রবৃদ্ধি (CAGR) ১০%-এর বেশি, যা দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেও ছাড়িয়ে গেছে। সামাজিক উন্নয়নের সূচকে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে, যা প্রমাণ করে সরকারি ব্যবস্থার কার্যকারিতা।

বলা গুরুত্বপূর্ণ, দেশের ৭৫% এর বেশি স্বাস্থ্য ব্যয় ব্যক্তিখাত থেকে আসে — যা ভোক্তাদের চাহিদার পরিবর্তন ও বেসরকারি খাতে বিপুল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। এমনকি ৩৭% সাধারণ মানুষও ব্যক্তিখাতের মাধ্যমেই চিকিৎসা নিচ্ছে।

তবে বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের বিদ্যমান অবকাঠামো — প্রতি হাজার মানুষের জন্য মাত্র ১টি হাসপাতালের শয্যা এবং ডব্লিউএইচওর সুপারিশ অনুযায়ী কমসংখ্যক দক্ষ চিকিৎসা কর্মী — এই চাহিদা মেটাতে পারছে না।

এই চিত্র বিনিয়োগকারী ও উদ্যোক্তাদের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খাতে বড় সুযোগ তৈরি করছেঃ

১. এখনই বিনিয়োগের সেরা সময়ঃ

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে এখনই বিনিয়োগ করার সঠিক সময়। এখন যারা বিনিয়োগ করছেন, তারা একেবারে শুরুর পর্যায়ে গিয়ে মানসম্মত চিকিৎসার অভাব পূরণ করতে পারেন, এবং সরকার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের জন্য নানা সুবিধা দিচ্ছে।

জনপ্রতি মাথাপিছু স্বাস্থ্য ব্যয় এখনো এই দেশের আশেপাশের অঞ্চলের অন্য দেশের তুলনায় কম। তবে ২০৪০ সালের মধ্যে তা দ্বিগুণ হবে বলে অনুমান করা যায়। যা বিনিয়োগকারীদের জন্য বিরল সুযোগ।

গত দুই দশকে হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ৬ গুণ বেড়েছে। তবে আরও প্রয়োজন রয়েছে। বিশেষ করে এই ধরনের প্রতিষ্ঠান দরকার যেগুলো মানের ওপর গুরুত্ব দেয়। প্রাভা হেলথ বাংলাদেশের ১১টি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ডায়াগনস্টিক সেন্টারের একটি পরিচালনা করে। এর অর্থ দাঁড়ায় প্রতি ১.৬ কোটি মানুষের জন্য ১টি মানসম্পন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার—যা পরিষ্কারভাবে যথেষ্ট নয়। যেখানে ভারতের ক্ষেত্রে ৫.৭৫ লাখ মানুষের জন্য আছে একটি।

এটা স্পষ্ট—বাংলাদেশের অনেক নিম্ন ও মধ্য আয়ের মানুষ মারা যাচ্ছে শুধু চিকিৎসার অভাবে নয়, মানসম্মত চিকিৎসার অভাবে। আমাদের প্রয়োজন ক্লিনিক, ল্যাব, হাসপাতাল, প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসহ প্রাথমিক অবকাঠামোতে বিনিয়োগ। এটি যেমন সামাজিক প্রয়োজনে সাড়া দেয়া হবে, তেমনি আর্থিকভাবেও লাভজনক হবে।

২. স্বাস্থ্য বীমার বিস্তারঃ

বর্তমানে মাত্র ১% বাংলাদেশি স্বাস্থ্য বীমার আওতায় রয়েছে —যা বিশাল এক সম্ভাবনাময় খাত। একটি সুসংগঠিত স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের ঝুঁকি হ্রাস করতে পারে এবং স্বাস্থ্যসেবা আরও সহজলভ্য করে তুলতে পারে।

৩. স্বাস্থ্যসেবা কর্মী গড়ে তোলাঃ

চিকিৎসক, নার্স, টেকনিশিয়ানসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষা খাতেও বিনিয়োগ জরুরি — মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট এবং কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র গড়ে তোলা জরুরি।

৪. ডিজিটাল হেলথ ইনোভেশন ব্যবহারঃ

বাংলাদেশের ডিজিটাল স্বাস্থ্য বাজার ইতোমধ্যেই বছরে ১০% এর বেশি হারে বাড়ছে, এবং কয়েক বছরের মধ্যে ৪০০ মিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে বলে অনুমান করা যায়।

প্রযুক্তি ভবিষ্যৎ নয়—এটাই বর্তমান। এটি ক্লিনিকাল ট্রায়ালকে দ্রুত করছে, ফার্মা কোম্পানিগুলোর কার্যক্রমকে আরও কার্যকর করছে। রিমোট মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সংকট হ্রাস করছে এবং সারা দেশে মানসম্মত চিকিৎসার সুযোগ বাড়াচ্ছে।

বাংলাদেশে ডিজিটাল সংযোগও বাড়ছে। ২০২২ সালে যেখানে ৩৮% পরিবার ইন্টারনেট ব্যবহার করত, ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০%। একই সময়ে ব্যক্তি পর্যায়ে ব্যবহার ৩৭% থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৬%।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত এখন এশিয়ার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ গুলোর একটি। জনগণ উন্নত সেবার জন্য প্রস্তুত, সরকার বেসরকারি অংশগ্রহণকে উৎসাহ দিচ্ছে, আর চাহিদা নিয়মিত সরবরাহকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এখনই সময়— যথার্থভাবে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যসেবা খাতের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার এবং এমন ব্যবসা তৈরি করার, যা কেবল লাভজনক নয়, সামাজিকভাবে প্রভাবশালী।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ শুধু ভালো ব্যবসাই নয় — এটি বুদ্ধিদীপ্ত এবং বহু আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ছিল। যারা সাহস করে এগিয়ে আসবেন, তাদের পুরস্কার শুধু মুনাফা নয় — লক্ষ লক্ষ জীবনের উন্নতির মধ্যেও নিহিত থাকবে।

লেখকঃ সিলভানা সিনহা

সূত্রঃ ফোর্বস

এম.কে
১৬ এপ্রিল ২০২৫

আরো পড়ুন

অফিসে বসেই মদ পান করতেন কবির বিন আনোয়ার

বাংলাদেশে বিদ্যুৎ দেবে না ভারত, যে সিদ্ধান্ত নিল সামিট

নিউজ ডেস্ক

সীমান্তে গুলি চালাতে পারে বিএসএফ, বিজিবির মাইকিং