2.7 C
London
January 22, 2025
TV3 BANGLA
বাংলাদেশযুক্তরাজ্য (UK)

কেন কেয়ার স্টারমার বিতর্কিত পরিবারের সন্তান টিউলিপকে মন্ত্রী করেছিলেন

টিউলিপ সিদ্দিকের খালা শেখে হাসিনার শাসনামলে মানুষ ‘গায়েব’ হয়ে যেত, অনেক মানুষকে গুম করা হয়েছে কিন্তু এরপরও কেয়ার স্টারমার কেন তাকে মন্ত্রী করলেন সেটা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে।

বাংলাদেশে প্রায় ৮ বছর গুম হয়ে থাকা এক ব্যক্তি বলেন, ” এটি এমন অনুভূতি যেন আমাকে জীবন্ত কবর দেওয়া হয়েছিল।”

যখন মীর আহমাদ বিন কাসেমকে রাতের আঁধারে বাংলাদেশে তার বাড়ি থেকে সশস্ত্র লোকেরা অপহরণ করেছিল, তখন তার ছোট মেয়েটি ঘটনাটি বুঝে ওঠার মতো যথেষ্ট বড় ছিল না।

মীর আহমাদ বিন কাসেম বলেন, ” তারা আমাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, আমি খালি পায়ে ছিলাম।” তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, “আমার ছোট মেয়ে আমার পেছনে আমার জুতা নিয়ে দৌড়াচ্ছিল। যেন মনে করছিল আমি চলে যাচ্ছি চিরতরে।”

তিনি আট বছর একক কারাবাসে ছিলেন, হাতকড়া এবং চোখ বাঁধা অবস্থায়। কিন্তু এখনও তিনি জানেন না কোথায় এবং কেন তাকে বন্দি রাখা হয়েছিল।

৪০ বছর বয়সী এই ব্রিটিশ-প্রশিক্ষিত ব্যারিস্টার বাংলাদেশের তথাকথিত ‘নিখোঁজ’ ব্যক্তিদের একজন। তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূর্নীতি ও অনৈতিক কাজের একজন সমালোচক ছিলেন। শেখ হাসিনা দুই দফায় প্রায় ১৭ বছরেরও বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় ছিলেন। বিগত ৫ আগস্টে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।

মীর আহমাদ বিন কাসেমের জানান, হাসিনার পতনের পর হঠাৎ তাকে তার আটককৃত সেল থেকে জাগিয়ে তোলা হয়। একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে পরে অন্ধকারাচ্ছন্ন জায়গায় ফেলে দেওয়া হয়। অবশেষে তিনি তার দুই মেয়ের কাছে ফিরে আসেন।
যে শিশুরা ২০১৬ সালে তাকে শেষবার দেখেছিল, তারা এখন তরুণী।

তিনি অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বলেন, ” আমি আমার সন্তানদের আসলেই চিনতে পারিনি, আর তারাও আমাকে চিনতে পারেনি। কখনো কখনো এটি সহ্য করা কঠিন হয়ে যায় যে আমি আমার মেয়েদের বড় হতে দেখা থেকে বঞ্চিত হয়েছি। আমি জীবনের সেরা অংশটি মিস করেছি। আমি তাদের শৈশব মিস করেছি।”

হাসিনার শাসনামলে বাংলাদেশ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে। শত শত মানুষ নিহত হয়েছিল শেখ হাসিনার শাসনামলে। যার মধ্যে অন্তত ৯০ জন নিহত হন তার ক্ষমতায় থাকার শেষ দিনে অর্থাৎ ৫ আগস্টে।

নিজের কর্মকাণ্ডে বিতর্কিত শেখ হাসিনা হলেন লেবার পার্টির এমপি টিউলিপ সিদ্দিকের খালা। টিউলিপ সিদ্দিক গত সপ্তাহে স্যার কিয়ের স্টারমারের দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রীর পদ থেকেও পদত্যাগ করেন।

টিউলিপ সিদ্দিক যুক্তরাজ্য লেবার সরকারের দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী ছিলেন। অভিযোগ উঠেছে তার পরিবার বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে খরচ হওয়া প্রায় ৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাৎ করেছে এবং তিনি লন্ডনের এমন সম্পত্তি ব্যবহার করেছেন যা তার খালার মিত্রদের সাথে যুক্ত।

সরকারি নৈতিকতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা পরে জানায়, অনেক কাজ সঠিক হয় নাই একজন মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে। তবে অবশেষে টিউলিপ সিদ্দিক নিজেই পদত্যাগ করেন।

তবে এই সকল ঘটনা কেয়ার স্টারমারের বিচারবুদ্ধি এবং লেবারের বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ভোটারদের আকৃষ্ট করার কৌশল সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করেছে।

লেবার পার্টি কেন এই ঘটনাটি আগে থেকে আঁচ করতে ব্যর্থ হলো, সেই প্রশ্ন এখন উঠছে, কারণ তারা বহুদিন ধরেই জানতো টিউলিপ সিদ্দিকের তার বিতর্কিত ও স্বৈরশাসক একমাত্র খালা শেখ হাসিনার সাথে সম্পর্কের কথা।

২০১৬ সালেই মীর আহমাদ বিন কাসেমের ঘটনাটি প্রথম টিউলিপ সিদ্দিকের কাছে উত্থাপিত হয়। এরপরও, বাংলাদেশে “নিখোঁজ” হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়টি সিদ্দিকের মানবাধিকার নিয়ে প্রকাশ্য অবস্থানের সাথে একধরনের অস্বস্তিকর টানাপোড়েন তৈরি করেছে।

উদাহরণস্বরূপ, সিদ্দিক তার নির্বাচনী এলাকার বাসিন্দা নাজনিন জাগারিকে ইরান থেকে মুক্ত করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে প্রচারণা চালিয়েছেন। কিন্তু তার খালার শাসনামলে বাংলাদেশে হওয়া নিপীড়ন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে তুলনামূলকভাবে তিনি প্রকাশ্যে খুব কমই কথা বলেছেন।

টিউলিপ সিদ্দিক এর আগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সাথে শেখ হাসিনার একটি বৈঠকে উপস্থিত হয়েছিলেন এবং বিবিসির একটি অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের একজন মুখপাত্র হিসেবে বক্তব্য রেখেছিলেন।

তিনি ২০১৫ সালে লেবার পার্টি থেকে নির্বাচিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সদস্যদের তাকে সমর্থন করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। এমনকি তার ওয়েবসাইটে ২০০৮ এবং ২০০৯ সালের দুটি পৃষ্ঠায় আওয়ামী লীগের সাথে তার সম্পর্কের উল্লেখ ছিল, যা পরে সরিয়ে ফেলা হয়।

যদিও সংসদে টিউলিপ সিদ্দিক সাংবাদিকদের বলেছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে তার কোনো উচ্চাভিলাস নেই। তবে তার সাথে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ও তার খালার সম্পর্কগুলো কোনো গোপন বিষয় ছিল না। বরং, লেবার পার্টি হতে এই বিষয় নেতিবাচকভাবে দেখা হয়নি। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লেবার পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে দূরত্ব বজায় রাখার কোনো ইঙ্গিত দেয় নাই।

কেয়ার স্টারমার, ২০১৫ সালে টিউলিপ সিদ্দিকের সাথে একই সময়ে পার্লামেন্ট সদস্য হয়েছিলেন। তিনি একাধিকবার শেখ হাসিনার সাথে দেখা করেছেন বলেও তথ্যমতে জানা যায় ।

২০২২ সালে, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্য লন্ডনে থাকা অবস্থায় তখনকার বাংলাদেশি প্রধানমন্ত্রীর সাথে স্টারমারের একটি সাক্ষাৎ হয় বলেও জানা যায়।

স্টারমারের একটি ঘনিষ্ঠ সহযোগী বলেছেন, হাসিনার সাথে দেখা করা “সম্পূর্ণ বৈধ” ছিল এবং এটি শেখ হাসিনার নীতির প্রতি সমর্থনের কোনো ইঙ্গিত দেয় না।
লেবারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশি ভোটারদের সমর্থন ধরে রাখার প্রয়াসে যুক্তরাজ্যের বাস্তব রাজনীতি প্রতিফলিত করে। বিশেষ করে লন্ডনের কিছু অংশে এটি গুরুত্বপূর্ণ।

একজন অভিজ্ঞ লেবার নেতা বলেন, “পূর্ব লন্ডনে সাফল্য পেতে হলে বাংলাদেশি ভোটারদের বুঝতে হবে। তবে বাংলাদেশের বিভক্ত এবং অস্থিতিশীল রাজনীতি পুরোপুরি না বোঝা গেলে ফল হতে পারে উল্টো। যদি আপনি কোনো এক বাংলাদেশি দলের প্রতি বেশি স্পষ্ট সমর্থন দেখান, তাহলে সমালোচিত হবেন।”

ফাইনান্সিয়াল টাইমসের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের অন্তত ১৭টি সংসদীয় এলাকায় বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে।

কেয়ার স্টারমারের নিজস্ব সংসদীয় আসন হোলবর্ন এবং সেন্ট প্যানক্রাস নির্বাচনী এলাকায় অন্তত ৬,০০০ প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বাসিন্দা রয়েছেন।

এই বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীর সাথে উষ্ণ সম্পর্ক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা স্টারমারের বিচারবুদ্ধিকে আড়াল করেছিল বলে অনেকে মত দিয়েছেন। গত জুলাই মাসে নির্বাচনে জয়লাভের পরপরই, স্টারমার টিউলিপ সিদ্দিককে যুক্তরাজ্যের দুর্নীতিবিরোধী মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন।

“স্টারমার তার বন্ধু এবং রাজনৈতিক মিত্রদের জন্য মাঝে মাঝে অন্ধভাবাপন্ন হয়ে পড়েন,” বলেন লেবার দলের একটি সূত্র নিশ্চিত করে।

সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যান, প্রায় এক দশক ধরে টিউলিপ সিদ্দিকের বাংলাদেশের রাজনীতির সাথে সম্পর্ক উন্মোচন করে আসছেন। তিনি বলেন, “প্রেক্ষাপট সবকিছু নির্ধারণ করে। এই বিষয়টি বড় ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়নি, যতক্ষণ না লেবার ক্ষমতায় আসে। টিউলিপ সিদ্দিক মন্ত্রী হন এবং আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়।”

তিনি মনে করেন, পার্টির ভেতর থেকেই বহু বছর আগে এ বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা উচিত ছিল। ” টিউলিপ সিদ্দিকের বাংলাদেশে গুম ও নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা নিয়ে কোনো সাড়া ছিল না। তিনি যুক্তরাজ্যের আওয়ামীলীগের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নিয়ে অন্ধভাবাপন্ন ছিলেন।”

আমি যখন এই বিষয়ে একজন লেবার এমপিকে বলি, তিনি পাল্টা উত্তর দেন, যুক্তরাজ্যের মিডিয়া এবং লেবার পার্টি উভয়ের মধ্যেই বাংলাদেশকে নিয়ে একধরনের উদাসীনতা কাজ করছে। ব্রিটেনে প্রায় ৬ লক্ষ বাংলাদেশি মানুষের বসবাস রয়েছে। এটি বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম জনসংখ্যার দেশ।

উল্লেখ্য যে, হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতি তদন্ত আরও অনেক দিন চলবে বলে মনে করা হচ্ছে। যা স্টারমারের দলের জন্য নতুন নতুন সমস্যা তৈরি করতে পারে। এদিকে, টিউলিপ সিদ্দিক এখনও লেবার এমপি হিসেবে আছেন।

সূত্রঃ বিবিসি

এম.কে
২১ জানুয়ারি ২০২৫

আরো পড়ুন

বাংলাদেশ লাগোয়া করিমগঞ্জের নাম বদলে হলো ‘শ্রীভূমি’

ভারতে ‘বৈধভাবে’ থাকার সময় ফুরিয়ে আসছে শেখ হাসিনার

খালেদ মুহিউদ্দীন ২ হাজার শহিদের সঙ্গে বেঈমানি করেছেন