16.3 C
London
April 18, 2025
TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

কেন বাংলাদেশকে আসিয়ানে যোগ দেওয়া উচিতঃ দ্য ডিপ্লোম্যাট

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীল বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এখন ‘পূর্বমুখী’ নীতি গ্রহণ করছে। দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আঞ্চলিক সংযোগ এবং কৌশলগত বহুমুখীকরণের জন্য বাংলাদেশ বহুদিন ধরে আসিয়ান জোটে যোগ দেয়ার আশায় রয়েছে।

আসিয়ান ৬৮০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের একটি বিশাল বাজার, যার সম্মিলিত জিডিপি ৪.৫ ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি– যা ইউরোপের বাইরের বৃহত্তম আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট। এই ব্লক বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর প্রতিযোগিতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কাজ করে এবং এটি ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক রূপান্তর ও আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার করার ক্ষেত্রে সফলতার প্রমাণ দিয়েছে।

বাংলাদেশের জন্য আসিয়ান যোগদান একটি সময়োপযোগী ও কৌশলগত সুযোগ, বিশেষ করে যখন দেশটি স্বৈরাচারী শাসন থেকে দ্বিতীয় মুক্তির পর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার সম্মুখীন এবং তার ঐতিহ্যবাহী অংশীদারদের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের চেষ্টায় যুক্ত।

আসিয়ান বাংলাদেশকে বিকল্প প্রবৃদ্ধির দিগন্ত দিতে পারে। বর্তমানে বাংলাদেশের ৮৫ শতাংশের বেশি রপ্তানি পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল, যা প্রধানত ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকায় কেন্দ্রীভূত।

কিন্তু বিশ্ব পরিবর্তিত হচ্ছে। নতুন বহুকেন্দ্রিক বৈশ্বিক ব্যবস্থায় অর্থনৈতিক উন্নতির কারণে বাংলাদেশ শিগগিরই এই বাজারগুলোতে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত বাণিজ্য প্রবেশাধিকার হারাতে পারে, যা ৭ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত রপ্তানি কমিয়ে দিতে পারে। তাই আসিয়ানের দিকে ঝোঁকা শুধু ইচ্ছার ব্যাপার নয়, বরং অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।

আসিয়ানের ১০টি সদস্য দেশ ইতোমধ্যেই মুক্ত বাণিজ্য নীতি, প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ এবং বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে সংযুক্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিক কাঠামো পরিবর্তন করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ভিয়েতনাম আসিয়ান ও RCEP-এ (Regional Comprehensive Economic Partnership) সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে এবং ব্যাপক বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে।

বাংলাদেশের লক্ষ্যও একই। ফার্মাসিউটিক্যাল, তথ্যপ্রযুক্তি এবং কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প পরিণতির স্তরে পৌঁছেছে, কিন্তু আঞ্চলিক সংযোগের অভাবে এই খাতগুলো প্রসারিত হতে পারছে না।

আসিয়ান সদস্যপদ বাংলাদেশকে এই বিশাল বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, বৈচিত্র্যময় বাণিজ্য অংশীদার এবং বহুপাক্ষিক বাণিজ্য আলোচনার ক্ষমতা দেবে। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আসিয়ানের অংশীদার RCEP-এ যোগ দিলে বাংলাদেশ তার রপ্তানি ১৭ শতাংশ এবং জিডিপি ০.২৬ শতাংশ বৃদ্ধি করতে পারবে।

ভৌগোলিকভাবে, বাংলাদেশ দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থিত এবং বঙ্গোপসাগরে বিশাল প্রবেশাধিকার রয়েছে। তাই বাংলাদেশ আসিয়ান এবং ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু হতে পারে। মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর এবং এশিয়ান হাইওয়ের মতো প্রকল্পগুলো বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক লজিস্টিক হাবে পরিণত করতে পারে এবং আসিয়ানের সমুদ্রপথ নির্ভরশীলতা কমাতে সাহায্য করতে পারে।

তাছাড়া, সদস্যপদ অর্জন করলে বাংলাদেশ তার ভূরাজনৈতিক কৌশলে বৈচিত্র্য আনতে পারবে, বিশেষত যখন দেশটি ভারতকেন্দ্রিক কৌশলের বাইরে যেতে এবং চীনের উপর নির্ভরশীলতা কমাতে চাইছে। আসিয়ান বাংলাদেশকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো শক্তিগুলোর সাথে একটি ভারসাম্যপূর্ণ প্ল্যাটফর্মে যুক্ত করবে, যা আসিয়ান+৩ ও পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।

আসিয়ান ইতোমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্র-চীন প্রতিযোগিতার মধ্যে নিজের ‘কেন্দ্রীয়তা’ বজায় রাখতে সফল হয়েছে, বাহ্যিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করার পাশাপাশি স্বাধীন কূটনৈতিক অবস্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশ যদি আসিয়ানের কৌশল অনুসরণ করতে পারে, তবে এটি আরও শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থান, উন্নত বাণিজ্য চুক্তি এবং জ্বালানি ও অবকাঠামো খাতে গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারবে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ তার যুব জনসংখ্যা – ৬৫ শতাংশের বেশি জনগণ ৩৫ বছরের নিচে। আসিয়ান এই উদীয়মান ও দক্ষ জনশক্তির সুবিধা নিতে পারে। আসিয়ানের শ্রম গতিশীলতা কাঠামোর অধীনে, বাংলাদেশের কর্মীরা কৃষি, নির্মাণ, স্বাস্থ্যসেবা এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ভালো কর্মসংস্থান পেতে পারে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশ আসিয়ান সদস্যদের কাছ থেকে কারিগরি প্রশিক্ষণ, দক্ষতা উন্নয়ন এবং অটোমেশন সম্পর্কে শিখতে পারবে, যা ভবিষ্যতের শ্রমবাজারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা, ডিজিটাল পরিষেবা এবং স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমে গভীর সহযোগিতার মাধ্যমে উভয় পক্ষের প্রবৃদ্ধি অর্জিত হতে পারে।

আসিয়ানে অন্তর্ভুক্তির জন্য বাংলাদেশকে কিছু বড় বাধার মুখোমুখি হতে হবে। সবচেয়ে বড় বাধা হলো রোহিঙ্গা সংকট। ২০১৭ সাল থেকে ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, এবং মিয়ানমারের বিরোধিতার কারণে আসিয়ানের মধ্যস্থতায় সমস্যার সমাধান কঠিন হতে পারে।

আসিয়ান এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র মানবিক সহায়তায় সীমাবদ্ধ থেকেছে, কিন্তু সমস্যার মূল কারণ নিরসনে কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। মিয়ানমার এই সংকটের কারণে বাংলাদেশের সদস্যপদ আটকে দিতে পারে। তবে, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মতো সমমর্মী আসিয়ান সদস্যদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ আঞ্চলিক সমর্থন পেতে পারে।

আসিয়ানের মুক্তবাণিজ্য কাঠামোতে যোগ দিলে বাংলাদেশের নবীন শিল্প – ইলেকট্রনিক্স, ফার্মাসিউটিক্যাল, হালকা প্রকৌশল – উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোর সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়তে পারে।

কিন্তু এই প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে থাকার পরিবর্তে, বাংলাদেশকে উদ্ভাবন, গবেষণা ও উন্নয়ন (R&D) এবং মূল্য সংযোজন উৎপাদনে বিনিয়োগ করতে হবে। প্রস্তুতির মাধ্যমে প্রতিযোগিতাকে শিল্প উন্নয়নের সুযোগে পরিণত করা সম্ভব।

আসিয়ান সদস্যপদ অর্জন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের একমাত্র সমাধান নয়, তবে এটি সঠিক পথে একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাকার্তা ও কুয়ালালামপুর সফরে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ আসিয়ান ও সার্কের মধ্যে একটি সেতুবন্ধন হতে পারে।’

আসিয়ানের জন্য বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি একটি সাহসী পদক্ষেপ হবে, যা এশিয়ার দুটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলের সংযোগ ঘটাবে। আর বাংলাদেশের জন্য, এটি স্বনির্ভরতার পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হবে।

তবে শুধু উচ্চাকাঙ্ক্ষা যথেষ্ট নয়। নতুন বাংলাদেশকে সংস্কারে প্রস্তুত হতে হবে, নেতৃত্ব দিতে হবে এবং শুধু সুবিধাভোগী নয়, বরং আঞ্চলিক সহযোগিতায় অবদানকারী হিসেবেও প্রমাণ করতে হবে।

সূত্রঃ দ্য ডিপ্লোম্যাট

এম.কে
০৩ এপ্রিল ২০২৫

আরো পড়ুন

আমার মায়ের মতো একই পরিণতির হুমকি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকেঃ সজীব ওয়াজেদ

আইইএলটিএস পরীক্ষায় বড় পরিবর্তন, ২৫ জানুয়ারি থেকে কার্যকর

উপদেষ্টার পদ থেকে পদত্যাগ করলেন নাহিদ ইসলাম