কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশে যে সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা দৃশ্যত সামাল দিয়েছে সরকার। তবে এই আন্দোলন সামাল দিতে গিয়ে সরকার যেসব কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে, তার সমালোচনা করছে আন্তর্জাতিক মহল। বিষয়টি নিয়ে সরকারের উপর নানামুখী চাপ আসতে শুরু করেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সহিংসতায় সপ্তাহের কম সময়ে দুই শতাধিক মানুষের মৃত্যু এবং কয়েক হাজার মানুষ আহত হওয়ার বর্তমানে দেশব্যাপী যে গ্রেপ্তার অভিযান চলছে, তার উপর নজর রাখছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশ। এ ছাড়া জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিভিন্ন বৈশ্বিক সংস্থা এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংগঠনের নজরদারিতে আছে পুরো বিষয়টি। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে সরকারের উপর চাপ বাড়ছে বলে মনে করেন তারা।
বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্ট ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আন্দোলনের সময়কার পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক পরিসরে চাপ বাড়ছে। এর কারণ, সরকার যেভাবে বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তা নিচ্ছে না।’ তিনি বলেন, মার্কিন সিনেটে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা চাক শুমার দেশটিতে বেশ প্রভাবশালী রাজনীতিক। তিনি বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে যা বলছেন, তার যথেষ্ট তাৎপর্য আছে।
উল্লেখ্য, চাক শুমার গত মঙ্গলবার এক এক্স-পোস্টে (সাবেক টুইটার) জানান, তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি গভীর উদ্বেগের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ কর্মসূচির বিরুদ্ধে সহিংস নিপীড়নকে ভুল পদক্ষেপ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘এতে অস্থিরতা বাড়বে।’
বাংলাদেশ জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য—বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘সেখানে যদি বিষয়টি উঠে, আলোচনা হয়, এই কাউন্সিল যদি বাংলাদেশ পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে তদন্ত কমিশন গঠন করে, আর জাতিসংঘ যদি বিষয়গুলোর উপর নজরদারির জন্য একজন বিশেষজ্ঞ (র্যাপোর্টার) নিযুক্ত করে, তাহলে সরকারের জন্য তা ভালো কিছু বয়ে আনবে না।’
এখনই সতর্ক না হলে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে ভবিষ্যতে চাপ আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন বিদেশে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশের কয়েকজন কূটনীতিক। তারা বলছেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, নিরস্ত্র মানুষকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলি, দেশের ভেতরকার অভিযানে জাতিসংঘের লোগোযুক্ত যানবাহন ব্যবহারসহ বিভিন্ন কারণে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নজরদারি বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশে সহিংস পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পৃথক দুটি প্রস্তাব এনেছেন ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত দুই সদস্য রুপা হক ও আপসানা বেগম।
বাংলাদেশে যা চলছে, তা নিয়ে সম্প্রতি রোম, প্যারিস, ম্যানচেস্টার ও লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে বিক্ষোভের কথা উল্লেখ করে রুপা হক গত বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে বলেন, এমন পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্য সরকারের ভূমিকা দরকার।
প্রাণহানির ঘটনায় আপসানা বেগম গত সোমবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আলোচনার জন্য একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। এতে প্রভাবশালী স্বতন্ত্র এমপি জেরেমি করবিনসহ ২২ জন ব্রিটিশ এমপি স্বাক্ষর করেছেন।
ওই প্রস্তাবের জবাবে পার্লামেন্টে লেবার সরকারের মুখপাত্র লুসি পাওয়েল এমপি জানান, চলমান সহিংসতার বিষয়ে তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। প্রাণহানি অগ্রহণযোগ্য। এ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ হালনাগাদ তথ্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উপস্থাপনের নিশ্চয়তা দেন তিনি।
কূটনৈতিক সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, ভারত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জার্মানি, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ অর্ধশতাধিক দেশে বাংলাদেশিরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ করেছেন। এসব বিক্ষোভ কারা করেছে, সে বিষয়ে তথ্য চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে চিঠি দিতে শুরু করেছে।
এদিকে এবারের আন্দোলনের সময় সহিংসতায় কতজন নিহত হয়েছেন, কত লোক আহত হয়েছেন, আর কতজনকে আটক করা হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য প্রকাশের জন্য বাংলাদেশ সরকারের প্রতি গত বৃহস্পতিবার আহ্বান জানান জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থার প্রধান ফলকার তুর্ক। তিনি বিক্ষোভ সামাল দেওয়ার সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর আন্তর্জাতিক নীতি ও মান মেনে চলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
কয়েক দিনের সহিংসতায় দুই শতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার তথ্য মিলছে বেসরকারিভাবে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এ নিয়ে কিছুই বলা হয়নি এখন পর্যন্ত। ঠিক কত মানুষ এ পর্যন্ত মারা গেছেন, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে সরকারের মন্ত্রীরা জবাব এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে মনে করেন বিদেশি কূটনীতিকেরা।
গত বুধবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে বিদেশি কূটনীতিকেরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে।
বিক্ষোভকারীদের উপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সরাসরি গুলি করায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটির মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক গত বৃহস্পতিবার নিউইয়র্কে বলেন, বাংলাদেশে যা ঘটছে, যে গণগ্রেপ্তার ও হত্যাকাণ্ড হয়েছে, তা তারা দেখছেন। সব সহিংস কর্মকাণ্ডের তদন্ত স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্যভাবে করার তাগিদ দেন তিনি।
জার্মান সরকার বৃহস্পতিবারের বিবৃতিতে সহিংসতার ঘটনাগুলোর তদন্ত এবং তাতে জড়িত এমন অভিযোগে গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে সঠিক আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণের তাগিদ দেয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ যে মূল নীতিগুলোর উপর (১৯৭১ সালে) প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা কার্যকর করা এবং সাম্প্রতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেন।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ঊর্ধ্বতন পরিচালক ডিপ্রোজ মুচেনা বৃহস্পতিবারের বিবৃতিতে বলেছেন, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকা এবং সক্রিয় পর্যবেক্ষণের সীমাবদ্ধতার মধ্যেও বিক্ষোভ দমনে বেআইনিভাবে প্রাণঘাতী ও কম প্রাণঘাতী—উভয় ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে।
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠার পর সংগঠিত সবচেয়ে বড়, ব্যাপক ও জনপ্রিয় আন্দোলন হিসেবে অভিহিত করেছে ব্রাসেলসভিত্তিক ক্রাইসিস গ্রুপ। সংস্থাটির পরিচালক পিয়েরে প্রকাশ গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেন, কর্তৃত্ববাদী শাসন, দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি যখন ধুঁকছে, তার ভেতর সরকার নিজেই এই আন্দোলনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিরোধী দলসহ সবার সঙ্গে সংলাপের পরিবেশ তৈরির পরামর্শ দেন তিনি। পিয়েরে বাংলাদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে ভারতকেও ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান।
ক্রাইসিস গ্রুপ একই সঙ্গে সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপসহ প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে।
আন্তর্জাতিক সব কর্তৃপক্ষ ইন্টারনেট পরিষেবা দ্রুত চালু করার জন্যও সরকারকে তাগিদ দিয়েছে।
সার্বিক দিক নিয়ে সাবেক কূটনীতিক ও বিশ্লেষক হুমায়ুন কবির বলেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় যে অভিযোগগুলো তুলছে, তার সপক্ষে বিভিন্ন প্রমাণ এরই মধ্যে তারা সংগ্রহ করেছে। সরকারের উচিত সবকিছু ঢালাওভাবে অস্বীকার করার অবস্থান থেকে সরে আসা। কাজে বস্তুনিষ্ঠ হওয়া। কোথাও ঘাটতি থাকলে স্বীকার করা।
এম.কে
২৭ জুলাই ২০২৪