খুলনা–১ (দাকোপ–বটিয়াঘাটা) আসনে প্রথমবারের মতো হিন্দু সম্প্রদায়ের একজনকে প্রার্থী করায় জামায়াতে ইসলামীর মনোনয়নকে ঘিরে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। ডুমুরিয়া উপজেলা হিন্দু কমিটির সভাপতি কৃষ্ণ নন্দীকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার ঝড় বইছে। এর আগে এই আসনে দলটির প্রার্থী ছিলেন মাওলানা আবু ইউসুফ।
জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান খুলনায় ৩ ডিসেম্বর ৮ দলের বিভাগীয় সমাবেশে কৃষ্ণ নন্দীর প্রার্থিতা ঘোষণা করেন। ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও জামায়াতের টিকিট পাওয়ায় সমালোচনার পাশাপাশি প্রশ্ন উঠছে মনোনয়ন প্রক্রিয়া, যোগ্যতা এবং তার রাজনৈতিক অতীত নিয়ে।
কৃষ্ণ নন্দী পেশায় ব্যবসায়ী। ডুমুরিয়ার চুকনগরেই তার বাড়ি, ব্যবসা ও পারিবারিক শেকড়। মোটরসাইকেল শোরুম, তেল, রড–সিমেন্টের ব্যবসা তার দীর্ঘদিনের পেশা। তিনি দাবি করেন, ২০০৩ সালে সাবেক জামায়াত সাংসদ মিয়া গোলাম পরওয়ারের হাত ধরে সংগঠনে যোগ দেন। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, ২০২৪ সালের আগস্টে রাজনৈতিক সহিংসতার সময় পর্যন্ত তাকে দলীয়ভাবে সক্রিয় দেখা যায়নি।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সহিংসতায় ক্ষুব্ধ জনতা তার বাড়ি–ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালালে কৃষ্ণ নন্দী আবার সক্রিয়ভাবে সংগঠনে যুক্ত হন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। পরবর্তীতে তিনি উপজেলা হিন্দু কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পান এবং ৩১ অক্টোবর জামায়াতের হিন্দু সম্মেলনে বিপুল সংখ্যক মানুষকে একত্রিত করার ভূমিকা রাখেন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি শিপন কুমার বসুর সঙ্গে কৃষ্ণ নন্দীর কয়েকটি ছবি ভাইরাল হয়। সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের এসব ছবি শেয়ার করে দাবি করেন—২০১৩ সাল থেকে কৃষ্ণ নন্দী ভারতের বিশেষ একটি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন এবং ওই ছবি একটি বৈঠকের, যেখানে ভারতের আইবি কর্মকর্তাও উপস্থিত ছিলেন।
সায়েরের দাবি আরও, ছবিগুলো ফরেনসিক বিশ্লেষণে কোনো এআই টেম্পারিং পাওয়া যায়নি এবং ভ্রমণ ইতিহাস যাচাই করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে কৃষ্ণ নন্দী উল্লিখিত সময়ে ভারতে ছিলেন। তিনি ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ২২ বার ভারত ভ্রমণ করেছেন বলে উল্লেখ করেন প্রতিবেদক।
এ অভিযোগ অস্বীকার করে কৃষ্ণ নন্দী বলেন, “ছবির ব্যক্তিকে আমি চিনি না। এআই জেনারেটেড ছবি ব্যবহার করে আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে।”
তবে সমালোচকরা বলছেন, তার ভারতের হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রাজনৈতিকভাবে ব্যাখ্যার দাবি রাখে।
কৃষ্ণ নন্দীর অতীত রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক উঠেছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অভিযোগ, তিনি ছিলেন সাবেক মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের ঘনিষ্ঠজন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের যুগল ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল মনে করে, জনগণের ক্ষোভের মুখে পড়ার পর রাজনৈতিক আশ্রয় পেতে তিনি জামায়াতের মনোনয়ন চান। তবে কৃষ্ণ নন্দীর দাবি, “ব্যবসায়িক কারণে মন্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল, রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা নয়।”
খুলনা–১ আসনটি দেশের অন্যতম হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা। দাকোপে ৫৪% এবং বটিয়াঘাটায় ২৭% মানুষ হিন্দু সম্প্রদায়ের। মোট ভোটারের প্রায় ৪৩% হিন্দু হওয়ায় সংখ্যালঘু প্রার্থী এখানে নিয়মিত সফল হয়েছেন। আওয়ামী লীগের ননী গোপাল মন্ডল ও পঞ্চানন বিশ্বাস একাধিকবার জয়ী হয়েছেন।
জামায়াত এই আসনে ১৯৯৬ সালের পর আর প্রার্থী দেয়নি। প্রায় তিন দশক পরে গতানুগতিক মুখ মাওলানা ইউসুফকে বাদ দিয়ে হঠাৎ কৃষ্ণ নন্দীকে প্রার্থী করায় দলের ভেতরেও বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে। তবে ইউসুফ বলছেন, “দলের সিদ্ধান্ত মেনে আমি কৃষ্ণ নন্দীর প্রচারণায় আছি।”
এদিকে বিএনপির আমীর এজাজ খানও শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে আছেন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বাইরে এ আসনে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছেন তিনিই। ফলে এ লড়াইয়ের বাস্তবতায় প্রশ্ন উঠেছে—কৃষ্ণ নন্দী আদৌ ভোটের মাঠে কতটা টিকতে পারবেন।
নিজের সমর্থন সম্পর্কে কৃষ্ণ নন্দীর দাবি, “এ আসনে আমার আত্মীয়স্বজন ও পরিচিতজন প্রচুর। হিন্দু–মুসলিম সবাই আমাকে সমর্থন দিচ্ছে।”
সব মিলিয়ে কৃষ্ণ নন্দীকে কেন্দ্র করে খুলনা–১ আসনে নতুন করে উত্তপ্ত হয়েছে রাজনৈতিক মাঠ; ভাইরাল ছবি, সংস্থার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগ, আওয়ামী লীগের অতীত ঘনিষ্ঠতা ও জামায়াতের হঠাৎ মনোনয়ন—সব মিলিয়ে এই নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা পরিণত হয়েছে সবচেয়ে আলোচিত লড়াইয়ে।
সূত্রঃ স্যোশাল মিডিয়া
এম.কে

