18 C
London
September 19, 2024
TV3 BANGLA
Uncategorized

ঝালমুড়ি-চানাচুর-আঁচার ও মসলা রপ্তানিতে আশা দেখাচ্ছে বাংলাদেশ

নাগরিক জীবনে নানা ব্যস্ততার মধ্যে ঝামেলা এড়াতে মানুষ এখন প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে ঝুঁকছেন। ফলে এ খাতে তৈরি হয়েছে অপার সম্ভাবনা। শুধু দেশেই নয়, রপ্তানি খাত হিসেবেও দিন দিন বড় হচ্ছে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের বাজার। মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, নেপাল ও আফ্রিকার দেশগুলোর পর ইউরোপ থেকে আমেরিকার বাজারে যাচ্ছে বাংলাদেশের মুড়ি, ঝালমুড়ি, চানাচুর, আঁচার-মসলাসহ নানা ধরনের খাদ্যপণ্য।

উৎপাদক ও রপ্তানিকারকরা বলছেন, বাংলাদেশ থেকে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য বিশ্বের ১৪৫টি দেশে রপ্তানি হচ্ছে। এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য-আফ্রিকার পর বাংলাদেশি খাদ্যপণ্য এখন ইউরোপেও যাচ্ছে। ভবিষ্যতে এর পরিসর আরও বড় হবে। ইউরোপের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়াতেও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এসব দেশে পণ্যগুলোর চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে এ খাত দেশের নতুন রপ্তানি খাত হিসেবে আশা দেখাচ্ছে। তবে, কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারলে এখনই দুই বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব– বলছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।

বিশ্বে খাদ্যের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বিশ্বব্যাংকের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কৃষিপণ্য রপ্তানির বাজার চার ট্রিলিয়ন ডলার। ভেরিফায়েড (যাচাইকৃত) মার্কেট রিসার্চের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে বিশ্বে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের বাজার ছিল ১৪৩.৫১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বার্ষিক ৬.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ২০২৮ সাল নাগাদ এ বাজার হবে ২৩৫.৬৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে রয়েছে বেভারেজ, ডেইরি, মিট অ্যান্ড পোল্ট্রি, বেকারি, স্ন্যাকস, কনফেকশনারি পণ্য। এসব পণ্যের সবচেয়ে বড় ক্রেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ইউরোপের দেশগুলো এ বাজারের প্রায় ৪০ শতাংশ দখল করে রেখেছে। বাংলাদেশের চেয়ে আয়তনে ছোট নেদারল্যান্ডের কৃষিপণ্যের রপ্তানি ১০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশকে এত দূর যেতে হলে সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে এগিয়ে যেতে হবে।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে থাইল্যান্ড কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে অনেক এগিয়ে। খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প দেশটির তৃতীয় বৃহৎ খাত। দেশটির মোট জিডিপির শতকরা ২৩ শতাংশ আসে এ খাত থেকে। প্রতি বছর কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য রপ্তানি করে থাইল্যান্ড ৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করে। বাংলাদেশে কৃষিপণ্যের মাত্র ১ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত হয়। অন্যদিকে, ভিয়েতনামের ৫ শতাংশ, চীনে ৩৮, ফিলিপাইনে ৩১, আমেরিকায় ৭০, থাইল্যান্ডে ৮১ ও মালয়েশিয়ায় ৮৪ শতাংশ কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাত হয়।

বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১২ শতাংশ এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য খাতের অবদান ১.৭ শতাংশ। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রক্রিয়াকরণ ও সংরক্ষণের অভাবে বাংলাদেশে প্রতি বছর মোট উৎপাদনের ৩০ শতাংশ ফসল নষ্ট হয়। পণ্য উৎপাদনের সব পর্যায়ে অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে পারলে এ অপচয় রোধ করা সম্ভব।

জানা যায়, এক যুগ আগেও ড্রাই ফুড বা শুকনা খাদ্যপণ্য রপ্তানি করেছে হাতেগোনা কয়েকটি শিল্পগ্রুপ। প্রাণ-আরএফএল, স্কয়ার, এসিআই ফুডসসহ কয়েকটি শিল্পগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এ বাজার। কিন্তু বৈশ্বিক বাজারে গত কয়েক বছরে রপ্তানিতে যুক্ত হয়েছে নতুন নতুন শিল্পপ্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠান এতদিন দেশের বাজারে খাদ্যপণ্য বাজারজাত করে আসছিল। এখন দেশীয় বাজারের পাশাপাশি রপ্তানিতেও নজর দিয়েছে তারা।

বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৬৩ ধরনের মৌলিক কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্যসহ প্রায় ৭০০ ধরনের কৃষিপণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ। দেশে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত প্রায় ১০০০ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে রপ্তানির সঙ্গে জড়িত প্রায় ২৫০ প্রতিষ্ঠান। বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান আছে ২০টি। এ খাতে কর্মসংস্থান প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের। কৃষি খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে প্রায় ৮ শতাংশ অবদান রাখে।

কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যের মধ্যে বেশি রপ্তানি হয় রুটি, বিস্কুট, ঝালমুড়ি, চানাচুর জাতীয় শুকনা খাবার; সস, জেলি, আলুপুরি, পাঁপড়, নুডলস, ফলের রস (জুস), বিভিন্ন ধরনের মসলা ও আচার, পানীয় এবং জ্যাম-জেলি, চিপসসহ বিভিন্ন সুগার কনফেকশনারি পণ্য।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, দেশের শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি খাতের একটি কৃষি ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য। ২০২০-২১ অর্থবছরে প্রথমবারের মতো এ খাত এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের মাইলফলক অতিক্রম করে। ওই বছর এ খাতের রপ্তানি আয় ছিল ১০২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার। পরের বছর অর্থাৎ ২০২১-২২ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি আয় ছিল ১১৬ কোটি ২২ লাখ ডলার। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছরে রপ্তানি ২৭ শতাংশ কমে ৮৩ কোটি ডলারে নেমেছে।

এর আগে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি করে বাংলাদেশ আয় করেছিল ৭০ কোটি ৭০ লাখ মার্কিন ডলার। ২০১৯-২০ অর্থবছরে আয় করে ৯০ কোটি ৯০ লাখ ডলার।

উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের মতে, বেশ কয়েকটি কারণে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে নগদ প্রণোদনার হার কমানো, প্রক্রিয়াজাত পণ্যের কাঁচামালের দাম, পরিবহন খরচ ও বাড়তি ফ্রেইট চার্জ (পণ্য জাহাজিকরণের ভাড়া) বেশি গুণতে হচ্ছে। এসব কারণে উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে বাংলাদেশ।

এ খাতের কয়েকজন উদ্যোক্তা জানান, বিশ্বের ১৭৬টি দেশে বাংলাদেশের প্রায় দেড় কোটি কর্মী আছেন। যেসব দেশে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা বেশি সেখানে দেশীয় খাদ্যপণ্যের চাহিদাও বেশি। তাই প্রবাসী বেশি থাকা দেশগুলোতে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে বড় সম্ভাবনার সৃষ্টি হয়েছে। তবে, কিছু চ্যালেঞ্জ বা বাধার কারণে সম্ভাবনাটা কাজে লাগাতে পারছেন না দেশীয় উদ্যোক্তারা। এর মধ্যে অন্যতম কাঁচামাল আমদানিতে উচ্চ শুল্ক। অর্থাৎ প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের জন্য যেসব উপকরণ লাগে তা উচ্চ শুল্ক দিয়ে আমদানি করতে হয়। এক্ষেত্রে রপ্তানিমুখী কারখানা বন্ডেড ওয়্যার হাউজ সুবিধায় এসব উপকরণ শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করে। অন্য কারখানাগুলো এ সুবিধা না পেলেও নগদ সহায়তা পেত। কিন্তু সম্প্রতি নগদ সহায়তার হার অর্ধেক কমিয়ে এনেছে সরকার। এতে অনেক প্রতিষ্ঠান সমস্যায় পড়েছে।

তারা আরও জানান, আগামীতে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যেতে রপ্তানি আয় বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। তবে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রপ্তানি আয়ের পথে বাধা হিসেবে কাজ করছে। আগামী দিনে দেশের সামগ্রিক রপ্তানি বাড়াতে কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প হতে পারে বড় হাতিয়ার। এক্ষেত্রে এ শিল্পকে গুরুত্ব দিলে দেশের রপ্তানি খাত সমৃদ্ধ হবে। এ ছাড়া আগামী দিনে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছালে যখন শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার কমে যাবে সেই বিবেচনায় এখন থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

‘ভারতে এক কেজি চিনির দাম পড়ে ৫০ টাকা, পাকিস্তানে ৬০ থেকে ৬২ টাকা আর বাংলাদেশে ১৩০ টাকা অর্থাৎ দ্বিগুণের বেশি। চিনির মতো প্রক্রিয়াজাত পণ্যের প্রধান কাঁচামাল আটা, ময়দা, তেলের মতো পণ্যগুলোর দাম ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে বেশি। যার কারণে হিমায়িত খাবার তৈরিতে খরচ বেশি হচ্ছে। আগে নগদ সহায়তার মাধ্যমে কিছুটা খরচ সমন্বয় করা যেত। এখন তাও কমিয়ে অর্ধেক করে দিয়েছে সরকার।’

এ খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, বেশকিছু কারণে কৃষিপণ্য রপ্তানি কমেছে। দেশে অস্বাভাবিক খাদ্য মূল্যস্ফীতির কারণে অন্য রপ্তানিকারক দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে রপ্তানিযোগ্য খাদ্যপণ্যের দাম বেশি। ভারত ও পাকিস্তানের তুলনায় বাংলাদেশে সবজির মতো কৃষিপণ্যের দামও অনেক বেশি। আবার প্রক্রিয়াজাত পণ্যের কাঁচামালের দাম বেশি। যে কারণে আটা, ময়দা, তেল, চিনির মতো পণ্যগুলোর মাধ্যমে তৈরি হিমায়িত খাবারের খরচ বেড়েছে। অন্যদিকে রয়েছে ডলার সংকট। এ কারণে চলতি বছর কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়েছে। পণ্যের ব্যয় বেড়েছে, এলসি খোলা ও নিষ্পত্তিতে দেখা দিয়েছে জটিলতা। পাশাপাশি দেশ থেকে সুগন্ধি চালের রপ্তানি বন্ধ থাকায় এর বাজার হারানো, পাশাপাশি সুগন্ধি চালের কারণে অন্য পণ্যের রপ্তানি আদেশও কমেছে।

‘সর্বশেষ জুন মাসের নির্দেশনা অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানিতে নগদ প্রণোদনা কমিয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত করা হয়েছে, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হয়েছে। যদিও ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশ হবে বাংলাদেশ। এলডিসি থেকে উত্তরণের পর রপ্তানিতে নগদ সহায়তা বন্ধ হবে। তাই এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। রপ্তানি খাত টিকিয়ে রাখতে ছোট-বড় সব রপ্তানিকারকের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধায় উপকরণ আমদানির সুযোগ সৃষ্টি করা জরুরি।’

তদারকি সংস্থাগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সমন্বয়হীনতার কারণে রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে— জানিয়ে উদ্যোক্তা সৈয়দ সোয়াইব হাছান বলেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় উদ্যোক্তাদের না জানিয়ে সরকারি সংস্থাগুলো সক্ষমতা না জেনেই সিদ্ধান্ত নিয়ে চাপিয়ে দিচ্ছে। খাদ্যের নিরাপত্তা ও মানের ক্ষেত্রে একেক দেশ একেক নিয়মে চলে। রপ্তানি করতে গেলে ওই সব মান নিশ্চিত করতে হয়। কোনো কোনো দেশে পণ্যে সুগার বেশি থাকলে বেশি শুল্ক দিতে হয়। এসব বিষয়ে তদারকি সংস্থাগুলোরও সচেতন হতে হবে।

উদাহরণ হিসেবে এই উদ্যোক্তা বলেন, সরকারের অনেক সংস্থা থেকে কারখানা পরিদর্শনে আসে। তারা কোনো সমস্যা পেলে সরাসরি জরিমানা করে। সংশোধনের সময়ও দেয় না। এমন মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। নগদ প্রণোদনা বাড়াতে হবে। অর্থায়নের সুযোগ করে দিতে হবে। আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা চালু করতে পারলে কৃষি তথা প্রক্রিয়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাড়ানো সম্ভব হবে।

প্রযুক্তিগত সমস্যা রয়েছে— জানিয়ে সোয়াইব হাছান আরও বলেন, চীনসহ যেসব দেশ প্রযুক্তিতে এগিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনে শীর্ষ স্থানে থাকা থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে আমন্ত্রণ জানাতে হবে। তাহলে আমাদের উদ্যোক্তারা তাদের কাছ থেকে নতুন নতুন অনেক বিষয় শিখতে পারবে।

এম.কে
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আরো পড়ুন

US Immigration & Citizenship ll 19 July 2020

লকডাউনে ব্রিটেনের অবৈধ অবস্থানকারীদের কি করণীয়

Health Advice – Dr. Mushabbir Hoosain Rubel & Dr. Monjur Showkat