ট্রাম্প প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে শত শত আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল করেছে এবং ডজনখানেক শিক্ষার্থীকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে আটক করেছে বলে সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে জানা যায়। তাছাড়া অনেক শিক্ষার্থীদের কোনো সতর্কতা বা আপিলের সুযোগ ছাড়াই ভিসা বাতিল করা হচ্ছে।
গ্রেপ্তারের কিছু ভিডিওতে দেখা গিয়েছে— সাদা পোশাক পরিহিত কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের বাড়ির কাছ থেকে হাতকড়া পরিয়ে গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে—যে ভিডিও ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে এবং আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সমাজে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিয়েছে।
Inside Higher Ed-এর ট্র্যাকার অনুসারে ৮০টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ভিসা বাতিলের রিপোর্ট দিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও গত মাসে নিশ্চিত করেছেন কমপক্ষে ৩০০টি ভিসা বাতিল করা হয়েছে। তিনি জানান, এসব ভিসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কারণ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এমন কার্যকলাপে জড়িত ছিলেন যা “মার্কিন জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী”।
অনেক শিক্ষার্থী ফিলিস্তিনপন্থী আন্দোলন বা প্রতিবাদে অংশগ্রহণ করেছিলেন বিধায় তাদের ভিসা বাতিল করা হয়। আবার কেউ কেউ অতীতে কোনো আইন লঙ্ঘনের ঘটনায়, যেমন অতিরিক্ত স্পিডে ড্রাইভিং ও স্পিড লিমিট অতিক্রমের মতো ঘটনায় যুক্ত ছিলেন বলে ভিসা বাতিলের মুখে পড়েছেন বলে অভিবাসন আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের মার্কিন নাগরিকদের মতো মতপ্রকাশের অধিকার রয়েছে। অতীতে রাজনৈতিক মতপ্রকাশের জন্য শিক্ষার্থীদের দেশ থেকে বহিষ্কারের ঘটনা বিরল ছিল। তবে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা অস্থায়ী ভিসাধারী হওয়ায় তারা বেশি ঝুঁকিতে থাকেন।
আইনজীবীরা জানিয়েছেন, অনেক আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর ভিসা কোনো পূর্ব সতর্কতা ছাড়াই হঠাৎ বাতিল করা হয়েছে এবং তাদের কোনো আপিল বা সংশোধনের সুযোগ দেওয়া হয়নি।
রুবিও বলেছেন, শিক্ষার্থী ভিসা শুধুমাত্র শিক্ষার জন্য। তারা যদি কোনো “অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিকারী” কর্মকাণ্ডে জড়ায়, তাহলে ভিসা বাতিল করা হবে।
এক বিবৃতিতে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ভিসা বাতিলের সংখ্যা ৩০০ ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং শুধু শিক্ষার্থী নয়, বিভিন্ন ধরনের ভিসা বাতিল করা হচ্ছে।
তথ্যমতে জানা যায়, প্রধানত ফিলিস্তিনপন্থী প্রতিবাদে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদেরকেই বেশি টার্গেট করা হচ্ছে, তবে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের রেকর্ড থাকা অনেকেও ভিসা বাতিলের তালিকায় রয়েছেন।
এক তুর্কি নাগরিক এবং মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীকে মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোর অপরাধে মার্চ মাসে আটক করা হয় এবং তার ভিসা বাতিল করা হয়। আবার কোনো কোনো শিক্ষার্থীর ভিসা বাতিল হয়েছে পূর্বের স্পিডিং টিকেটের জন্য।
অধিকারকর্মী ও শিক্ষকদের আশঙ্কা, শিক্ষার্থীদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখন আমেরিকায় ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।
ACLU (আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন) জানিয়েছে, “কোনো প্রেসিডেন্ট যেন মতাদর্শের ভিত্তিতে লোক বেছে নিতে না পারেন এবং যার মতামত তার পছন্দ নয়, তাদের দেশ থেকে বের করে দিতে না পারেন।”
হোয়াইট হাউজ ১৯৫২ সালের একটি আইন ব্যবহার করছে ভিসা বাতিলের ক্ষেত্রে। যে আইন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এমন বিদেশিদের বহিষ্কারের ক্ষমতা দেয়, যারা “মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির জন্য গুরুতর ঝুঁকি”র কারণ হতে পারে।
Inside Higher Ed-এর ট্র্যাকার অনুসারে, ৮০টির বেশি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় এমন শিক্ষার্থীদের তালিকা দিয়েছে যাদের ভিসা বাতিল বা পরিবর্তন করা হয়েছে।
এর মধ্যে রয়েছেঃ
টেক্সাস এন্ড এম ইউনিভার্সিটি
ইউনিভার্সিটি অফ অরেগন
ইউনিভার্সিটি অফ ফ্লোরিডা
ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো
প্রাইভেট ইনস্টিটিউশনের মধ্যে রয়েছে,
হার্ভার্ড
ইয়েল
ডার্টমাউথ
কলাম্বিয়া
স্ট্যানফোর্ড
ফেডারেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেঃ
অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে অন্তত ৮ জনের ভিসা বাতিল হয়েছে।
ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে ৬ জনের,
পুরো ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটি সিস্টেম থেকে ৫৭ জনের,
ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে ৭ জনের,
উল্লেখ্য যে, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক ১১ লাখ আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী রয়েছে।
বহু শিক্ষার্থী ও শিক্ষক আটক হয়েছেন, যাদের মধ্যে কিছু আইনগতভাবে স্থায়ী বাসিন্দারাও ছিলেন।
আটকের পর তাদের যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ডিটেনশন সেন্টারে পাঠানো হয়, যেখানে তারা আমেরিকা হতে বহিষ্কারের অপেক্ষায় রয়েছেন।
অনেক ভিডিওতে দেখা গেছে, সাধারণ পোশাকের ICE কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের রাস্তায় থামিয়ে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাচ্ছেন।
কিছু শিক্ষার্থী দাবি করেছেন, তাদের কোনো কারণ না জানিয়েই আটক করা হয়েছে এবং তারা কোনো অপরাধও করেননি।
মাহমুদ খালিল নামের একজন কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েট, মার্চে তার বাড়ি থেকে আটক হন।
রুমেইসা ওজতুর্ক, টাফটস ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী, রমজানের অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে ছয়জন সরকারি ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা দ্বারা রাস্তায় ঘিরে ধরা হয় এবং উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়।
রাশা আলাওয়ি, ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অধ্যাপককে মোবাইলে হিজবুল্লাহ-সংক্রান্ত সহানুভূতিপূর্ণ ছবি ও ভিডিও পাওয়ায় গ্রেফতার করা হয়।
অনেক শিক্ষার্থী ও তাদের আইনজীবীরা আদালতে মামলা করেছেন, দাবি করেছেন তাদের কোনো কারণ না দেখিয়েই আটক ও ভিসা বাতিল করা হয়েছে, যা তাদের নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করে।
একটি আলোচিত মামলার উদাহরণঃ
জিয়াওতিয়ান লিউ, চীনের ২৬ বছর বয়সী পিএইচডি শিক্ষার্থী, ডার্টমাউথ কলেজে পড়তেন। তিনি দাবি করেছেন, কোনো সতর্কতা বা ব্যাখ্যা ছাড়া তার ভিসা বাতিল করা হয়েছে, অথচ তিনি কোনো অপরাধ বা প্রতিবাদে অংশ নেননি।
এই পুরো ঘটনার ফলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী সমাজের মধ্যে ভয়, অনিশ্চয়তা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে। অনেকেই বলছেন, এ ধরনের পদক্ষেপ আমেরিকায় শিক্ষার পরিবেশ এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে মারাত্মকভাবে হুমকির মুখে ফেলেছে।
সূত্রঃ বিবিসি
এম.কে
১১ এপ্রিল ২০২৫