অগাস্ট মাসের শুরুতে, যখন বাংলাদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং সরকারি দমনপীড়নের জেরে বাড়তে থাকে লাশের সংখ্যা তখন পরিস্থিতি বেগতিক দেখে দ্রুত হেলিকপ্টারে চড়ে ভারত পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। তার সাথে কোনো রাজনৈতিক সহযোগী ছিলেন না এবং তিনি তার সিনিয়র মন্ত্রীদের কাউকে বলেননি যে, তিনি চলে যাচ্ছেন। ৫ই অগাস্ট কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তিনি প্রতিবেশী ভারতে চলে যান। তখন থেকে সেখানেই আছেন হাসিনা। যে ছাত্র বিক্ষোভ হাসিনার পতন ত্বরান্বিত করেছিল তা ক্যাম্পাস থেকে দ্রুত দেশব্যাপী গণবিপ্লবে রূপান্তরিত হয়েছিল, দেশের কয়েক হাজার মানুষ হাসিনার অপসারণ এবং গণতন্ত্র প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানিয়েছিল। হাসিনার সরকার সহিংসতা ও গুলির মাধ্যমে বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল। যার জেরে শত শত মানুষ নিহত এবং হাজার হাজার আহত হয়েছিল।
৫ইআগস্ট হাসিনার দেশত্যাগের পর বিক্ষোভকারীরা তার সরকারি বাসভবনে আক্রমণ করে। সারা বাংলাদেশ আনন্দের সাথে দিনটি উদযাপন করে। কিন্তু নয়াদিল্লিতে ক্ষমতার করিডোরে, হাসিনার শাসনের পতনকে একটি বিপর্যয় হিসেবে দেখা হয়েছিল। ভারত দীর্ঘদিন ধরে হাসিনাকে সবচেয়ে বড় মিত্র হিসেবে দেখে এসেছে।
১৯৭৫ সালে তার পিতা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর একবার হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেয়া হয়েছিল এবং ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে পর্যন্ত তিনি তার স্বামী ও সন্তানসহ ছয় বছরেরও বেশি সময় ভারতে নির্বাসনে ছিলেন।
নয়া দিল্লিতে বিজেপি এবং কংগ্রেস উভয় দলের সঙ্গে হাসিনার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিগত সম্পর্ক বাংলাদেশকে ভারতের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এবং সবচেয়ে বিশ্বস্ত আঞ্চলিক মিত্র হতে সাহায্য করেছে। একই সাথে বাংলাদেশকে চীনের খপ্পর থেকে দূরে রাখতে সাহায্য করেছে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ পর্যন্ত তার প্রথম মেয়াদে এবং তারপরে ২০০৯ তে পুনঃনির্বাচিত হওয়ার পর, হাসিনা ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সাথে লাভজনক চুক্তি করার মাধ্যমে ভারতের দিকে অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতার হাত প্রসারিত করেন।
বিনিময়ে, তার শাসনব্যবস্থা ক্রমবর্ধমানভাবে নিপীড়ক ও কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠলেও ভারত সেদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে রাখে। বরং ভারতীয় কর্মকর্তা ও মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে বিরোধীরা বাংলাদেশের বিষয়ে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করে হাসিনাকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করার অভিযোগ তোলে। পাশাপাশি অন্যান্য দেশকে একটি কারচুপিপূর্ণ নির্বাচন মেনে নেয়ার জন্য চাপ দিতেও দ্বিধাবোধ করেনি ভারত। জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় ফিরে আসার পর বিদেশি কোনো সরকার প্রধান হিসেবে হাসিনাই প্রথম ভারত সফর করেন। গত ১৫ বছরে দুই দেশের সম্পর্কের প্রকৃতি ধীরে ধীরে বাংলাদেশে উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের একজন সিনিয়র ফেলো শাফকাত মুনির বলেছেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কটি মূলত একজন ব্যক্তি এবং একটি দলের সাথে সম্পর্ক হয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকজন বিশ্লেষকের মতো মুনিরও জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পর্যালোচনা করার জন্য নয়া দিল্লিকে আহ্বান জানিয়েছেন।
শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ এবং নোবেল পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যা ব্যাপক সংস্কার এবং হাসিনা সরকারের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও ইউনূস মনে করেন এটি একটি বিশাল চ্যালেঞ্জের কাজ। মুনির বলছেন- ‘এখন ভারতকে মেনে নিতে হবে যে শেখ হাসিনা চলে গেছেন, তিনি এখন ইতিহাস। দু’দেশের সম্পর্ককে সম্পূর্ণরূপে পুনঃস্থাপন করতে হবে। সরকার পরিবর্তনের উপর কোনো সম্পর্ক নির্ভর করতে পারে না।’
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সামনে আরো একটি হুমকির বিষয় হলো- ভারতে হাসিনার উপস্থিতি। যদিও তার পরিবার বলছে, হাসিনা ভারতে স্থায়ীভাবে থাকবেন না এবং তার প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ থেকে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রত্যর্পণের অনুরোধ করা হয়নি, তবে তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য অধিকার কর্মী এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের কাছ থেকে ক্রমবর্ধমান কল আসছে ভারতের কাছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা ও অপহরণে ভূমিকা রাখার অভিযোগে ১০০টিরও বেশি মামলা দায়ের করা হয়েছে এবং বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সাম্প্রতিক বিক্ষোভের সময় সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের সাথে গণহত্যা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে। যদিও হাসিনার সরকার এর আগে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ অস্বীকার করেছিল। হাসিনা ভারত সফরে যে কূটনৈতিক পাসপোর্ট ব্যবহার করতেন তাও বাতিল করেছে বাংলাদেশ সরকার।
এই সপ্তাহে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-এর নেতা মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর জন্য ভারতের কাছে সরাসরি আবেদন করেন। অভিযোগ করেন, হাসিনা বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য ভারতকে ‘নিরাপদ আশ্রয়’ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। আলমগীর বলেন, ‘ ভারতের কাছে আমাদের আহ্বান যে- আপনারা তাকে আইনি উপায়ে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হস্তান্তর করুন। তার বিচারের সিদ্ধান্ত এদেশের মানুষ নিয়েছে। তাকে সেই বিচারের মুখোমুখি হতে দিন।’
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞ তথা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. আলী রীয়াজ বলেছেন- ‘হাসিনার আকস্মিক পতনে ভারতকে একটি ‘গুরুতর গোয়েন্দা ব্যর্থতার’ মুখোমুখি হতে হয়েছিল। যার অর্থ উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক বিপর্যয়ের জন্য ভারত অপ্রস্তুত ছিল। ক্রমবর্ধমান ভারত-বিরোধী মনোভাব এখন বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে।’ ড. আলী রীয়াজ মনে করেন- ‘ভারত রাষ্ট্রীয় সম্পর্ককে গুরুত্ব না দিয়ে হাসিনা ও তার দলের সাথে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করে সব ডিম এক ঝুড়িতে রেখেছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত অলীক নীতি অনুসরণ করেছে। ফলস্বরূপ, ভারত এখন নিজেই একটি অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছে।’
হাসিনা সরকারের পতনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে ভারতের মোদি সরকারের প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশের নতুন শাসনের দ্বারা গণতান্ত্রিক সংস্কারের উল্লেখ সেভাবে পাওয়া যায়নি। পরিবর্তে প্রতিবেশী দেশে অস্থিরতা এবং হিন্দু সংখ্যালঘুদের হুমকির বিষয়ে ‘গভীর উদ্বেগ’ প্রকাশ করেছেন মোদি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সাথে ফোনালাপের পর মোদির প্রকাশিত একটি আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে বিষয়টিতে আবারও জোর দেয়া হয়েছিল। মার্কিন বিবৃতিতে বাংলাদেশের বিষয়ে কোনো উল্লেখ না থাকলেও ভারতীয় পক্ষ বলেছে যে- ‘দুই দেশের নেতা স্বাভাবিক অবস্থা দ্রুত পুনরুদ্ধার এবং আইনশৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছেন’।
মোদির মন্তব্যগুলি সীমান্তের ওপারে সমালোচিত হয়েছে। একজন বাংলাদেশী ভাষ্যকার বলেন, ‘আমরা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছি না। আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছি।’
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪