TV3 BANGLA
শীর্ষ খবরসারাদেশ

বাংলাদেশের গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে যা জানালো এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন

বাংলাদেশে গুম বিষয়ে কাজ করছেন এমন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ ও সংস্থাগুলোকে ঘৃণা ও মিথ্যা অপবাদ ছড়ানোর বিরুদ্ধে গত ৭ অক্টোবর একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি)। এতে বাংলাদেশে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনারের সফরের পরেও গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ মানবাধিকারের ব্যাপক লঙ্ঘন অব্যাহত থাকায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে সংস্থাটি।

 

বিবৃতিতে বলা হয়, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা হিসেবে সাব্যস্ত ঘটনাগুলোকে খতিয়ে দেখার জন্য স্বাধীন তদন্ত প্রক্রিয়া চালু করার বদলে সরকার ভুক্তভোগীদের পরিবারের প্রতি ভয়ভীতি প্রদর্শন ও নিগ্রহ তীব্রতর করেছে। কর্তৃপক্ষের উচিত অবিলম্বে মানবাধিকার রক্ষাকারীদের ওপর হয়রানি বন্ধ করা।

 

জাতিসঙ্ঘের স্বাধীন বিশেষজ্ঞদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর প্রসঙ্গে সংস্থাটি জানায়: জাতিসংঘের বিভিন্ন স্বাধীন বিশেষজ্ঞ, বিশেষত গুম প্রতিরোধ গোষ্ঠীর (Working Group on Enforced or Involuntary Disappearances বা WGEID) বিরুদ্ধে গুম বিষয়ে সংস্থাটির অব্যাহত অনুসন্ধিৎসার কারণে সরকারপন্থী গণমাধ্যম এবং সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক বিভিন্ন মিত্র মিথা প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে গুম হওয়া ৭৬ জন ব্যক্তির একটি তালিকার প্রেক্ষিতে একটি ভারতীয় গণমাধ্যমের অনলাইন সংস্করণ ডব্লিউজিইআইডির বিশ্বাসযোগ্যতা বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। প্রতিবেদনটিতে দুজন ভুক্তভোগীর নাম উল্লেখ করা হয়: ১। ইউনাইটেড ন্যাশনাল লিবারেশন ফন্টের (ইউএনএলএফ) ভূতপূর্ব সভাপতি রাজকুমার মেঘেন, যিনি সানায়াইমা রাজকুমার নামেও পরিচিত; এবং ২। কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্র, যিনি চিলহেইবা নামেও পরিচিত। জানা যায় যে, তিনি ইউএনএলএফ এর একজন মেজর।

 

রাজকুমার মেঘেন সম্বন্ধে ভারতীয় গণমাধ্যমের ঐ প্রতিবেদনে বলা হয়:

“জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের মতে, সানায়াইমা রাজকুমার বাংলাদেশে গুম হয়েছেন। ইউএনএলএফ এর এই সভাপতির আসল নাম রাজকুমার মেঘেন (সানায়াইমা তাঁর দলে ব্যবহৃত নাম)। তিনি বিএনপি-জামায়াত এর আমলে সেনাশাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সরকারের সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে কাজ করেছেন। কিন্তু ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে নেপালে আশ্রয় নেন এবং উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের ভারতীয় বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালান। এর ফলে বেশ কিছু শীর্ষ নেতা আটক হন, যাঁদেরকে এরপর ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ২০১০ সালের ৩০ নভেম্বর নেপাল থেকে দেশে প্রবেশের চেষ্টার সময়ে বিহারের পূর্ব চম্পারান জেলা থেকে তাঁকে আটক করা হয়। “

 

১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ তারিখে প্রকাশিত ইন্ডিয়া টুডের ঐ একই প্রতিবেদনে কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্র সম্বন্ধে বলা হয়:

“জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রতিবেদনে কেইথেল্লাকপাম নবচন্দ্র ওরফে চিলহেইবাকেও বলা হয়েছে বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তি। নবচন্দ্র ইউএনএলএফ এর সশস্ত্র শাখার একজন “মেজর”। সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনী বিএসএফের দাবি, ২০১৫ সালে ডওকির কাছে সিলেট-মেঘালয় সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশের চেষ্টার সময়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। মণিপুরের কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী নবচন্দ্রকে বাংলাদেশ পুলিশ ঢাকায় গ্রেফতার করে এবং গোপনে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের কাছে হস্তান্তর করে দেয়। ভারত এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। নবচন্দ্রকে ২০১৫ সালের ১৭ মার্চ মণিপুর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে তাঁর বিচার চলছে। বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের মতে, উত্তর-পূর্ব ভারতের এসব সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান শেখ হাসিনার সন্ত্রাসের প্রতি জিরো টলারেন্স নীতির অংশ।”

 

ঘৃণা ছড়াতে ভিত্তিহীন তথ্যের ব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়।

এএইচআরসি সকলের জন্য উন্মুক্ত গণমাধ্যমের এমন কিছু প্রতিবেদনের সন্ধান পেয়েছে, যার তথ্য অনুযায়ী ইন্ডিয়া টুডের রিপোর্টটি ভিত্তিহীন। ১৩ অক্টোবর ২০১০ তারিখে বিবিসি নিউজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে একজন ‘জ্যেষ্ঠ ভারতীয় কর্মকর্তা’র বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, “ইউএনএলএফ এর নেতা রাজকুমার মেঘেনকে এ মাসের শুরুতে (অক্টোবর ২০১০) বাংলাদেশ পুলিশ আটক করেছে।” বিবিসির ঐ একই প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তরের আগে বাংলাদেশ পুলিশ মেঘেনকে ‘আটক’ করেছে।

 

দুই সপ্তাহ পরে ২৭ অক্টোবর ২০১০ তারিখে বিবিসি নিউজে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিলো “গ্রেফতারকৃত ভারতীয় বিদ্রোহীর পরিবার তথ্য চায়”। মেঘেন রাজকুমারের নাম না জানা ‘পুত্র’ এবং ‘স্ত্রী রাজকুমারী ইবেনমুংশি’র উদ্ধৃতি তুলে ধরে বলা হয়, “পরিবারটি তিনি (মেঘেন) কোথায় আছেন বা কেমন আছেন সে বিষয়ে কিছুই জানে না এবং তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে অত্যন্ত শঙ্কিত।” মেঘেনের স্ত্রী বিবিসি নিউজকে বলেন, “ভারত বা বাংলাদেশে তাঁর যে বিচারের মুখোমুখি হওয়ার সম্ভাবনা আছে তার বিষয়ে আমার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু আমাদের জানা দরকার তিনি বেঁচে আছেন কিনা, সুস্থ আছেন কিনা, এবং আইনের সাহায্যে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ তাঁর আছে কিনা।” ঐ একই প্রতিবেদনে বলা হয়, “ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মেঘেন কোথায় কেমন আছেন সে বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্য করেনি।” প্রতিবেদনটিতে আরো বলা হয়, “২০০৯ সালে কঠোর দমন শুরু হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশ বিভিন্ন ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর ৫০ জনেরও বেশি নেতা-কর্মীকে হস্তান্তর করেছে। এছাড়া আরো অনেকেই গ্রেফতার এড়াতে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে গেছেন অথবা সীমান্তে ভারতীয় রক্ষীদের হাতে ধরা পড়েছেন।”

 

২০১০ সালের ৩ ডিসেম্বর বিবিসি নিউজে “বাংলাদেশে মণিপুর বিদ্রোহীর গোপনে আটক হওয়ার অভিযোগ” শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ভারতের গোয়াহাটির একটি আদালতে দেওয়া রাজকুমার মেঘেনের জবানবন্দি তুলে ধরা হয় এ প্রতিবেদনে। মেঘেন জানান যে, তিনি ২৯ সেপ্টেম্বর (২০১০) ঢাকায় গ্রেফতার হন এবং “ভারতে হস্তান্তর করার আগে তাঁকে দুই মাস বাংলাদেশে গোপনে বন্দি করে রাখা হয়।” এএইচআরসি বিবিসি নিউজের এই প্রতিবেদনে পাওয়া ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের শহর গোয়াহাটির আদালতে দেওয়া। মেঘানের একটি বক্তব্য তুলে ধরে। মেঘান বলেন, “আমাকে ৬১ দিন গোপন আটকাবস্থায় রাখা হয়েছিলো। মাত্র এ সপ্তাহেই আমাকে ভারতে পাঠানো হয় এবং বিহার প্রদেশে আটক দেখানো হয়।”

 

২০১০ সালের ২৯ নভেম্বর বিবিসি নিউজে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে রাজকুমার মেঘেন সম্বন্ধে বলা হয়, “যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ভারত ও বাংলাদেশের কাছে ভারতের মণিপুর প্রদেশের একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা সম্বন্ধে তথ্য চেয়েছে।”

 

মণিপুরের ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্টের (ইউএনএলএফ) সশস্ত্র শাখার একজন মেজর হিসেবে পরিচিত কেইথেল্লাকপাম চিলহেইবা ওরফে কে সি নবচন্দ্রের গুমের বিষয়টিও মণিপুরের বিভিন্ন স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ইউএনএলএফ এর বিবৃতির বরাত দিয়ে নিশ্চিত করেছে। ইউএনএলএফ এর আনুষ্ঠানিক বিবৃতি সম্বন্ধে গণমাধ্যমে পাওয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১১ ফেব্রুয়ারি (২০১০) সকাল ১০টায় চিলহেইবা ঢাকার (বাংলাদেশ) মোহাম্মদপুর থেকে ভারতীয় গোয়েন্দা ও বাংলাদেশ পুলিশের (কালো পোশাকের) [অর্থাৎ র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন] সম্মিলিত দলের হাতে আটক হন।

 

গুম থেকে সকল মানুষের সুরক্ষার আন্তর্জাতিক বিধিমালার অনুচ্ছেদ ২ অনুযায়ী, “গুম” হলো রাষ্ট্রের চর অথবা রাষ্ট্রের অনুমোদন, সমর্থন ও সম্মতিতে কাজ করা ব্যক্তি কর্তৃক গ্রেফতার, আটক, অপহরণ বা অন্য যেকোনো পন্থায় ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণ এবং পরবর্তী সময়ে আটক ব্যক্তির স্বাধীনতা হরণের বিষয়টি অস্বীকার করা অথবা আটক ব্যক্তি কোথায় কেমন আছেন তা গোপন করা, যার ফলে ব্যক্তির আটকের বিষয়টি আইনের আওতার বাইরে চলে যায়।”

 

১০ অক্টবর ২০২২
এনএইচ

আরো পড়ুন

ব্রিটিশ অর্থমন্ত্রীর শ্বশুরের বিরুদ্ধে সাড়ে ৫ মিলিয়ন পাউন্ড কর ফাঁকির অভিযোগ

অনলাইন ডেস্ক

মা হারালেন বরিস জনসন

অনলাইন ডেস্ক

সিরিয়ার শরনার্থী শিশু জার্মানির সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু