10.5 C
London
March 4, 2025
TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

বাংলাদেশের ভিতরের এক ভয়ংকর নির্যাতনাগারের সন্ধান

বাংলাদেশ নির্যাতন কেন্দ্রে পরিনত হয়েছিল বিগত সরকারের শাসনামলে। বিভিন্ন ব্যক্তির উপর সংগঠিত নির্যাতনের বিবরণে শোনা যায় যৌনাঙ্গে ইলেকট্রিক শক তাদের নিয়মিত দেওয়া হতো। অজ্ঞান করার ওষুধ ছাড়াই মুখ সেলাই করে দেওয়া হয়েছে অনেককে, নখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। চোখ বাঁধা অবস্থায় অন্ধকারে ফেলে রাখা হয়েছে দিনের পর দিন। মলমূত্রের সাথে অন্ধকার ঘরে দম আটকে যেত, এভাবেই কেটেছে রাতের পর দিন কিন্তু বোঝার কোনো উপায় থাকতো না রাত কি দিন চলছে।

এগুলো ছিল সেই ভয়ংকর নির্যাতনের কিছু নমুনা, যা বন্দিরা সহ্য করেছেন বাংলাদেশে ক্ষমতাচ্যুত সরকারের অধীনে পরিচালিত কথিত নির্যাতন চেম্বারগুলোতে। এই বন্দিশালাগুলোর উদ্দেশ্য ছিল বন্দিদের মানসিক ও শারীরিকভাবে ভেঙে ফেলা।

প্রথমবারের মতো, স্কাই নিউজ ঢাকার একটি গোপন বন্দিশালার ভেতরে প্রবেশ করেছে। এটি রাজধানীর এক সংরক্ষিত এলাকায় অবস্থিত, যেখানে কালো গেট দিয়ে প্রবেশ করলে বাংলাদেশের এলিট কাউন্টার টেররিজম বাহিনী র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)-এর ব্যারাক দেখা যায়। মানবাধিকার কর্মীরা র‍্যাবকে “মৃত্যুর বাহিনী” বলে অভিহিত করে থাকেন।

বন্দিশালার বাইরের অংশে বিশাল তালাবদ্ধ স্টিলের দরজা খোলা হলে দেখা গেল, এক সারিতে থাকা ছোট ছোট জানালাবিহীন কক্ষ—যেগুলোর আকার প্রায় একটি কফিনের সমান।

একটু বড় একটি কক্ষে পাওয়া গেল একটি ভারী ইস্পাতের চেয়ারের সন্ধান, যার সঙ্গে মোটা ধাতব বন্ধনী ও নিচে একটি বৈদ্যুতিক মোটর যুক্ত ছিল।

বেঁচে ফেরা বন্দিরা জানিয়েছেন, জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাদের চেয়ারে বেঁধে প্রবল গতিতে ঘুরানো হতো। সিলিংয়ে লাগানো ছিল কড়া, যেখানে বন্দিদের ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হতো। পাশের কক্ষগুলোতে সারি সারি শিকল দেখা গেছে।

আরেকটি ভবনে পাওয়া গেছে ফেনসিডিল নামে নিষিদ্ধ কফ সিরাপের বস্তা, যা বাংলাদেশে নেশার জন্য ব্যবহৃত হয়। সেখানে ছিল নকল টাকার বান্ডিল ও বিস্ফোরক, যা মানুষকে ফাঁসানোর জন্য ব্যবহার করা হতো বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT)-এর প্রসিকিউটররা দাবি করেছেন, এসব বন্দিশালা ক্ষমতাচ্যুত সরকারের “সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ” এর অংশ হিসেবে নির্যাতনের জন্য ব্যবহার করা হতো। তারা মনে করেন, এমন প্রায় ৮০০ গোপন বন্দিশালা বিভিন্ন বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত হতো।

অনেক বন্দিই ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ। ৭৭ বছর বয়সী হাসিনা বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় থাকা নেতা, যিনি দুই দফায় ২০ বছরেরও বেশি সময় দেশ শাসন করেছেন।

প্রথমে গণতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে প্রশংসিত হলেও, পরবর্তীতে তাকে স্বৈরশাসক হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়। তার শাসনামলে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তার, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে, তদন্তকারীরা দাবি করেন, তিনি বিরোধীদের দমন করতে গোপন বন্দিশালার বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। ধারণা করা হয়, এই সময়ের মধ্যে প্রায় ৩,৫০০ মানুষকে গুম করা হয়েছে।

হাসিনা দাবি করেছেন, তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র।

২০২৪ সালের আগস্টে তিনি পদত্যাগ করেন এবং দেশজুড়ে সহিংস আন্দোলনের পর ভারত পালিয়ে যান। বর্তমানে তিনি সেখানেই নির্বাসনে আছেন।

ICT তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দুইটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। বাংলাদেশ সরকার তাকে ফিরিয়ে আনার জন্য ভারতের কাছে প্রত্যর্পণের আবেদন জানিয়েছে এবং একটি আইনজীবী দল তাকে ঢাকায় বিচারের মুখোমুখি করতে কাজ করছে।

২০১৯ সালে, আদিবাসী অধিকারকর্মী মাইকেল চাকমা-কে চোখ বেঁধে একটি গাড়িতে তুলে নেওয়া হয়। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় এক গোপন বন্দিশালায়, যার কোডনেম ছিল “হাউজ অব মিররস”। অপহরণকারীরা নিজেদের “প্রশাসনের লোক” হিসেবে পরিচয় দেয়।

সেখানে তাকে অস্ত্রের মজুদ ও শেখ হাসিনার সমালোচনা নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এক কর্মকর্তা তাকে হুমকি দেন—”উত্তর না দিলে তোমাকে ইলেকট্রিক শক দেব, তারপর পুড়িয়ে ছাই বানিয়ে ফেলব।”

তিনি ৫ বছরের বেশি সময় বন্দি ছিলেন। সেই সময় তিনি এক প্রহরীকে অনুরোধ করেছিলেন, “আমাকে গুলি করে মেরে ফেলুন!”

তার পরিবার আশা ছেড়ে দিয়েছিল এবং তার শেষকৃত্যের আয়োজন করেছিল।

২০২৪ সালে হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হলে, একদিন মাইকেল চাকমাকে চোখ বাঁধা অবস্থায় এক বনভূমিতে ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়। তার অপহরণকারীরা তাকে বলেছিল, “৩০ মিনিট অপেক্ষা করো, তারপর চোখ খুলবে।”

ছয় মাস পরেও তিনি আতঙ্কে ভুগছেন। তিনি বলেন, “আমি যখন দিনের আলো দেখলাম, মনে হলো অলৌকিক কিছু ঘটেছে।” তবে তিনি এখনো প্যানিক অ্যাটাক ও দুঃস্বপ্নের শিকার।

হাজারো পরিবার এখনো তাদের প্রিয়জনের ফেরার অপেক্ষায় দিন গুনছে বাংলাদেশে। হাজেরা খাতুন প্রতি রাতে তার ছেলের জন্য প্রার্থনা করেন এবং গেট খোলা রাখেন, যদি কখনো সাজেদুল ইসলাম সুমন ফিরে আসে।

সুমন ছিলেন বিএনপি নেতা ও এক কর্মী। ২০১৩ সালে, তিনি ও আরও পাঁচজনকে র‍্যাব সদস্যরা ধরে নিয়ে যায়, বলে পরিবার অভিযোগ করেছে।

তার বোন সানজিদা বলেন, “আমরা সরকারের এক দফতর থেকে আরেক দফতরে গিয়েছি, কিন্তু কেউ অভিযোগ নিতে রাজি হয়নি।”

তিনি এখন গুম হওয়া ব্যক্তিদের জন্য একটি সমর্থন নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন।

২০২৪ সালের আগস্টে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি কমিশন গঠন করেছে। তারা ১,৭০০ পরিবারের অভিযোগ গ্রহণ করেছে, তবে ধারণা করা হচ্ছে ভুক্তভোগীর সংখ্যা ৩,৫০০ পর্যন্ত হতে পারে।

অনেকেই মনে করেন, মামলাগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ICC), হেগে পাঠানো উচিত।

কিন্তু অনেক বাংলাদেশিই চান, ন্যায়বিচার দেশের মাটিতেই হোক—এবং দ্রুত হোক।

সূত্রঃ স্কাই নিউজ

এম.কে
০৪ মার্চ ২০২৫

আরো পড়ুন

বন বিভাগের জমিতে সাবেক চিফ হুইপ আবদুস শহীদের চা বাগান

ঢাকার বেওয়ারিশ কুকুরের ব্যবস্থাপনা করবে কে?

১২ দেশে হচ্ছে টিউলিপের অর্থপাচারের তদন্ত