5.2 C
London
December 26, 2025
TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

বাংলাদেশে পিএনএস সাইফের ঐতিহাসিক আগমনঃ বদলে যাচ্ছে বঙ্গোপসাগরের ভূরাজনীতি

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তান নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ পিএনএস সাইফ (PNS SAIF)-এর আগমন দক্ষিণ এশিয়ার সামুদ্রিক কূটনীতিতে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক সৃষ্টি করেছে। ৫৪ বছর পর কোনো পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশ করল—যা শুধু এক সৌজন্য সফর নয়, বরং বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও কূটনৈতিক অবস্থানে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচনের ইঙ্গিত বহন করছে।

চার দিনের এই সফরকে ঘিরে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে দীর্ঘদিনের সামরিক দূরত্বের অবসান ঘটল বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন। বিশেষ করে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে এই সফরটি বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা নীতিতে নতুন ভারসাম্য খোঁজার প্রতিচ্ছবি হিসেবেও দেখা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে পিএনএস সাইফের উপস্থিতি দক্ষিণ এশিয়ার সামুদ্রিক কৌশলে নতুন মাত্রা যোগ করেছে, যেখানে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং আঞ্চলিক দেশগুলো প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফ ৮ থেকে ১২ নভেম্বর ঢাকা সফরকালে এ সফরকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তুলেছেন, যা দুই দেশের মধ্যে সামরিক ও নৌ-কূটনৈতিক সম্পর্কের নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে।

১৯৭১ সালের পর থেকে বাংলাদেশ–পাকিস্তান প্রতিরক্ষা সম্পর্ক কার্যত স্থবির ছিল। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত কোনো পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশের বন্দর স্পর্শ করেনি। ফলে পিএনএস সাইফের আগমন শুধু প্রতিরক্ষা কূটনীতির নয়, বরং ইতিহাসের এক “কৌশলগত পুনর্মিলন” হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।

দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ ভারতের কৌশলগত ঘনিষ্ঠতায় আবদ্ধ ছিল, আর পাকিস্তান মনোযোগ দিয়েছে আরব সাগর, উপসাগরীয় অঞ্চল ও চীনের সঙ্গে সহযোগিতায়। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্য পাল্টে যায়। এখন বাংলাদেশ নতুন করে চীন, পাকিস্তান, তুরস্ক ও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়ানোর পথে হাঁটছে।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর আধুনিকীকরণ প্রকল্পে ইতোমধ্যে চীনা প্রযুক্তিনির্ভর ফ্রিগেট, সাবমেরিন ও ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে—যা পাকিস্তানের সামরিক কাঠামোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ মিল রাখে। ফলে এই সফরকে দুই দেশের মধ্যে বাস্তববাদী প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্বের শুরু হিসেবে দেখা হচ্ছে।

পাকিস্তান নৌবাহিনীর প্রধান অ্যাডমিরাল নাভিদ আশরাফের নেতৃত্বে দেশটির নৌবাহিনী সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দ্রুত আধুনিকীকরণ সম্পন্ন করেছে। ২০২৩ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি পাকিস্তান নৌবাহিনীকে ব্লু-ওয়াটার নেভি বা গভীর সমুদ্রে টেকসই যুদ্ধক্ষম বাহিনীতে রূপ দিতে কাজ করছেন।

তার নেতৃত্বে পাকিস্তান নতুন প্রজন্মের ফ্রিগেট, সাবমেরিন, ও আনম্যানড সিস্টেম অন্তর্ভুক্ত করেছে। এখন সেই সক্ষমতা আরব সাগর থেকে বে অব বেঙ্গল পর্যন্ত বিস্তৃত হচ্ছে। বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন তার এই “পূর্বমুখী সামুদ্রিক কৌশল”-এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ঢাকায় তার এই সফর কেবল সৌজন্য সাক্ষাৎ নয়, বরং ভবিষ্যতে যৌথ নৌ মহড়া, প্রশিক্ষণ ও তথ্য বিনিময়ের পথ তৈরি করতে পারে।

চীন-পাকিস্তান যৌথভাবে নির্মিত জুলফিকার শ্রেণির (F-22P) এই ফ্রিগেটটি পাকিস্তানের নৌ শিল্প সক্ষমতার প্রতীক। জাহাজটি ১২৩ মিটার দীর্ঘ, সর্বোচ্চ ২৯ নট গতিতে চলতে পারে এবং ৪,০০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্ব অতিক্রমে সক্ষম।
এতে রয়েছে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা—C-802 অ্যান্টি-শিপ মিসাইল, FM-90N সারফেস-টু-এয়ার সিস্টেম, এবং ইউ-৭ টর্পেডোসহ আধুনিক সাবমেরিন প্রতিরোধ প্রযুক্তি।

এই জাহাজ আগে আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক মহড়া “AMAN”-এ অংশ নিয়েছে, যা পাকিস্তানকে বৈশ্বিক নৌ মঞ্চে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। বাংলাদেশের জন্য এটি একটি সুযোগ, যেখানে ভবিষ্যতে রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ বা প্রযুক্তি বিনিময়ের পথ খোলা হতে পারে।

চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজের আগমন স্বাভাবিকভাবেই ভারতের কৌশলগত মহলে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ভারত বরাবরই বাংলাদেশকে তার প্রতিরক্ষা পরিসরের অংশ হিসেবে বিবেচনা করেছে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে আন্দামান-নিকোবর ঘাঁটির কারণে।
কিন্তু বাংলাদেশের এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি—যেখানে পাকিস্তান, চীন ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার হচ্ছে—একটি বহুমুখী পররাষ্ট্রনীতি ও প্রতিরক্ষা ভারসাম্যের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

একই সঙ্গে চীন এই উন্নয়নকে ইতিবাচকভাবে দেখছে, কারণ দুই দেশই তার প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। অপরদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলো এখন বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের সামুদ্রিক সহযোগিতা জোরদার করার প্রয়োজন অনুভব করছে, যাতে দক্ষিণ এশিয়া পুরোপুরি চীন–পাকিস্তান অক্ষে সরে না যায়।

সূত্রঃ ডিফেন্স সিকিউরিটি এশিয়া

এম.কে

আরো পড়ুন

বাংলাদেশে নাগরিকদের নিরাপত্তায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানায় যুক্তরাষ্ট্র

শাহজালাল বিমানবন্দরের আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণেঃ বেবিচক

ফ্রান্সের মুসলিম নেতাদের ১৫ দিনের আলটিমেটাম

অনলাইন ডেস্ক