ভারতের বিমানবন্দর ও নৌবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি বন্ধ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। এর পরিবর্তে এখন মালদ্বীপের মাধ্যমে গার্মেন্টস পণ্য বিশ্বব্যাপী পৌঁছানো হচ্ছে। বাংলাদেশের এই সিদ্ধান্তের কারণে ভারতের নৌ ও বিমানবন্দর বিপুল রাজস্ব হারাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ভারতীয় কর্মকর্তারা।
শনিবার (২ নভেম্বর) এক প্রতিবেদনে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম লাইভ মিন্ট এ তথ্য জানিয়েছে ।
লাইভ মিন্টকে এমএসসি এজেন্সি (ইন্ডিয়া) প্রাইভেট লিমিটেডের মহাপরিচালক দীপক তিওয়ারি বলেছেন, “আগে বাংলাদেশের পণ্য ভারতীয় বিমানবন্দরের মাধ্যমে পরিবহন হত। কিন্তু এখন তারা অন্যান্য রুটে তাদের পণ্য পরিবহন করছে। যার অর্থ আগে এসব পণ্যের কার্গো থেকে ভারত যে রাজস্ব পেত সেটি এখন পাচ্ছে না। — এমএসসি এজেন্সি (ইন্ডিয়া) ভারতের অন্যতম বৃহৎ কার্গো পরিবহন সংস্থা।
দেশটির তিন কর্মকর্তা বলেছেন, বাংলাদেশ এখন তৈরি পোশাক পণ্য জাহাজে করে প্রথমে মালদ্বীপে পাঠাচ্ছে। এরপর সেখান থেকে বিমানে করে বিশ্বব্যাপী গন্তব্যে পৌঁছানো হচ্ছে পণ্যগুলো। যার মধ্যে রয়েছে এইচঅ্যান্ডএম এবং জারার মতো বিশ্বখ্যাত কোম্পানির পোশাকও।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। যার অর্থ ভারত দিয়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের পণ্য বিশ্বব্যাপী রপ্তানি করত ঢাকা।
ভারতের বদলে অন্য দেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি করলে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এছাড়া লজিস্টিক এবং কাঠামোগত প্রজেক্টে থাকা সহযোগিতাপূর্ণ সুযোগগুলো শঙ্কায় পড়তে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এক কর্মকর্তা বলেছেন, “বাংলাদেশের এমন সিদ্ধান্তে ভারত সরকার একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজছে। যেটি ভারত হয়ে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ তৈরি পোশাক পণ্য রপ্তানির বিষয়টি নিশ্চিত করবে এবং ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে।
অপর এক কর্মকর্তা বলেছেন, “বাংলাদেশের রপ্তানিকৃত এসব তৈরি পোশাক পণ্যের একটি বড় অংশ ভারতীয় অবকাঠামো বা কারখানায় উৎপাদিত হয়। যেগুলো বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় কোম্পানিগুলোই পরিচালনা করে। এই বিষয়টি (ভারত) সরকারের নজরে রয়েছে। ভারতের ওপর এটির প্রভাব কেমন হতে পারে এখন আমরা সেটি নিরূপণের চেষ্টা করছি।”
তবে এক শিল্প বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ভারতের ওপর কোনো রাগ বা বিরাগ থেকে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে তার মনে হচ্ছে না। মূলত নিজেদের সাপ্লাই চেইনের ওপর নিয়ন্ত্রণ এবং ভারতীয় বন্দরগুলোর মাধ্যমে সময়মতো পণ্য রপ্তানি না হওয়ায় বাংলাদেশ এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে ধারণা তার।
অরুণ কুমার নামের এই বিশেষজ্ঞ বলেছেন, “রপ্তানির ক্ষেত্রে নতুন রুটের মাধ্যমে কৌশলগত সুবিধা, সঙ্গে নিশ্চিত নির্ভরযোগ্যতা পাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে বাংলাদেশ। যা আন্তর্জাতিক পোশাক বাজারের কঠোর সময় সীমার ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া ভারতের বন্দরের ওপর থেকে নির্ভরতা কমিয়ে বাংলাদেশ তাদের সাপ্লাই চেইনের ওপর আরও নিয়ন্ত্রণ আরোপ করছে।”
অরুণ কুমার বলেছেন, গার্মেন্টস পণ্যকে পঁচনশীল পণ্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কারণ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে চালান পৌঁছে দিতে না পারলে অর্ডার বাতিল হয়ে যায়। গার্মেন্টস পণ্য এমন পণ্য যেটি একটি নির্দিষ্ট মৌসুমের পর ভ্যালু হারায়।
তবে ভারতের অ্যাপারেল এক্সপোর্ট প্রোমোশন কাউন্সিলের নির্বাহী সদস্য সংবাদমাধ্যম লাইভমিন্টের কাছে দাবি করেছেন, ভারতের মাধ্যমে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানি বন্ধ করলেও তাদের খুব ক্ষতি হবে না। তার দাবি, ভারতীয় বন্দরগুলো এমনিতেই অনেক ব্যস্ত। এ কারণে তারা তাদের বন্দর হয়ে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি বন্ধের জন্য আগেই ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
তিনি বলেছেন, “এ বিষয়টি খুব বড় কিছু নয়। ভারতীয় বিমানবন্দরগুলো ইতিমধ্যে অনেক ব্যস্ত। এবং আমরা বাংলাদেশের পণ্য ভারতীয় বিমানবন্দর দিয়ে রপ্তানির ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করতে সরকারকে অনুরোধ করেছি।”
ভারত হয়ে তৈরি পোশাক রপ্তানি বন্ধের সঙ্গে শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং তাকে আশ্রয় দেওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানিয়েছেন অপর এক কর্মকর্তা। তিনি বলেছেন, “শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশ এটি করছে বলে ভারত সরকার মনে করে না। টেক্সটাইল হলো বাংলাদেশের মেরুদণ্ড। যার অর্থ টেক্সটাইল পণ্য রপ্তানি বাড়াতেই তারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে।”
শেখ হাসিনাকে ভারতের আশ্রয় দেওয়ার সঙ্গে এই বিষয়ের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই।
২০২৪ অর্থবছরে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ কমেছে। এই অর্থবছরে এই খাত থেকে ৪৪ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন ডলার আয় হয়েছে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মূলত তৈরি পোশাক রপ্তানি কমায় রপ্তানি আয়ও কমেছে।
তবে ২০২৩ অর্থবছরে পোশাক রপ্তানি ১৭ শতাংশ বেড়ে ৪৬ দশমিক ৪৯ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছিল। যা ২০২২ অর্থবছরে ছিল ৩৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার।
গত বছর বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ তৃতীয় সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশের মর্যাদা অর্জন করে। বাংলাদেশের আগে কেবল ছিল চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সব মিলিয়ে গত বছর বাংলাদেশ যত বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছিল তার ৮০ শতাংশই এসেছিল তৈরি পোশাক খাত থেকে। অপরদিকে ভারতের তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের তুলনায় অর্ধেকেরও কম।
এদিকে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশ ও মালদ্বীপের রাষ্ট্রদূতের কাছে ইমেইল পাঠিয়েছিল সংবাদমাধ্যমটি। তবে প্রতিবেদন প্রকাশের সময় তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
মালদ্বীপ এয়ারপোর্টস কোম্পানি প্রাইভেট লিমিটেড সমুদ্র-বিমান পরিবহন সেবা দিয়ে থাকে। তারা পণ্য প্রথমে মালদ্বীপে নিয়ে যায়। এরপর সেখান থেকে বিমানের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী পাঠায়। এটির যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০২৪ সালের মার্চে। প্রথম যেসব পণ্য তারা পরিবহন করেছিল সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক পণ্য ছিল বলে কোম্পানিটির প্রতিবেদনে জানা গেছে।
তাদের সঙ্গে যুক্ত আছে কাতার এয়ারওয়েজ, আমিরাত, তার্কিস এয়ারলাইন্স, এরোফ্লোট, গালফ এয়ার, নিউস এয়ারলাইন্স এবং ইতিহাদ এয়ারওয়েজ। এই বিমানসংস্থাগুলোর মাধ্যমে কোম্পানিটি পণ্য পরিবহন করে।
লাইভমিন্টের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎপাদন হাব এবং ভারতের পণ্য রপ্তানির জায়গা। ২০২৪ অর্থবছরে ভারত বাংলাদেশে ২ দশমিক ১৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। যার মধ্যে শুধুমাত্র তুলা রপ্তানি করেছে ১ দশমিক ৮৬ বিলিয়ন ডলার। ২০২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে পণ্য রপ্তানি করে ভারত ২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছিল বলে দেশটির বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
এরমধ্যে ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত বাংলাদেশে ১ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। যার ১ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য শুধুমাত্র তুলা।
সূত্রঃ দ্য মিন্ট
এম.কে
০৩ নভেম্বর ২০২৪