বাংলাদেশি নাগরিকদের ভারত ভিসা দেওয়ার ক্ষেত্রে বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তনের পথে হাঁটছে নয়াদিল্লি। এখন থেকে ভিসা মঞ্জুর করার আগে আবেদনকারীদের কয়েক বছরের সোশ্যাল মিডিয়া কার্যক্রম খুঁটিয়ে দেখা হবে। বিশেষ করে ভারত-বিরোধী পোস্ট, মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া থাকলে ভিসা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে ভারত সরকার। ভারত সরকারের একাধিক শীর্ষস্থানীয় সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
এর পেছনে রয়েছে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে ঘটে যাওয়া একাধিক ঘটনা। ২০১৮ সালে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাওয়া কুষ্টিয়ার শিক্ষার্থী আফসারা আনিকা মিম ২০২০ সালে হঠাৎ করেই ভিসা বাতিলের নোটিস পান। অভিযোগ ছিল, নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) বিরোধী আন্দোলনের ছবি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছিলেন। নিজে আন্দোলনে অংশ না নিলেও কেবল ফেসবুক পোস্টের কারণেই তাকে ভারত ছাড়তে বাধ্য করা হয়।
একই সময়ে কলকাতায় সিএএ-বিরোধী বিক্ষোভে দাঁড়িয়ে স্লোগান দেওয়ার ছবি ফেসবুকে পোস্ট করায় এক বাংলাদেশি পর্যটককে পরদিনই দেশে ফেরত পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২৪ সালের আগস্টে আসামের শিলচরে এনআইটি-তে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি ছাত্রী মাইশা মাহজাবিনকে একটি ভারত-বিরোধী পোস্টে ‘হার্ট’ ইমোজি দেওয়ার অভিযোগে করিমগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ফেরত পাঠানো হয়। একই বছরের সেপ্টেম্বরে চ্যাংড়াবান্ধা সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে ফেসবুকে নিয়মিত ভারত-বিরোধী লেখালেখির অভিযোগে মোহাম্মদ আলমগীর নামের আরেক বাংলাদেশি পর্যটকের ভিসাও বাতিল করা হয়।
এই ধরনের ঘটনার ধারাবাহিকতার পর ভারত সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে যারা ভিসার আবেদন করবেন, তাদের সোশ্যাল মিডিয়া কার্যক্রম যাচাই করে তবেই ভিসা দেওয়া হবে। আগে যেসব ক্ষেত্রে বিষয়টি ব্যতিক্রম হিসেবে দেখা হতো, এখন সেটিকেই নিয়মে পরিণত করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
ভারত মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির আদলেই এই ব্যবস্থা চালু করতে যাচ্ছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দেওয়ার আগে আবেদনকারীর অন্তত পাঁচ বছরের সোশ্যাল মিডিয়া ইতিহাস পর্যালোচনা করে, ভারতও বাংলাদেশি নাগরিকদের ক্ষেত্রেও একই মডেল অনুসরণ করতে চায়। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, গত দেড় বছরে বাংলাদেশে যেভাবে প্রকাশ্যে ভারত-বিরোধী বক্তব্য ও পোস্ট বেড়েছে, তাতে এই সিদ্ধান্ত ছাড়া বিকল্প ছিল না।
তিনি আরও বলেন, বাকস্বাধীনতা সবারই আছে, এমনকি ভারতকে সমালোচনা করার অধিকারও আছে। কিন্তু একই সঙ্গে ভারতেরও অধিকার আছে— কাকে ভিসা দেওয়া হবে আর কাকে দেওয়া হবে না, তা নির্ধারণ করার। এই নীতির আওতায় আবেদনকারী নিজের সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইল পাবলিক রেখেছেন কি না, সেটিও যাচাই করা হবে।
উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে ভারতের স্বাভাবিক ভিসা কার্যক্রম প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। কেবল জরুরি মেডিক্যাল ও ইমার্জেন্সি ভিসা সীমিত আকারে দেওয়া হচ্ছিল। বর্তমানে ধীরে ধীরে ভিসা কার্যক্রম বাড়ানো হচ্ছে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী ও খুলনার পাঁচটি ভিসা কেন্দ্র থেকে প্রতিদিন কয়েকশ’ ভিসা ইস্যু করা হলেও তা এখনও আগের পর্যায়ে পৌঁছায়নি।
নতুন এই সোশ্যাল মিডিয়া যাচাই মূলত ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী আবেদনকারীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অপ্রাপ্তবয়স্ক ও প্রবীণরা এর বাইরে থাকবেন। দীর্ঘদিন ধরে মেডিক্যাল ভিসায় ভারতে চিকিৎসাধীন ব্যক্তিরাও এই যাচাইয়ের আওতার বাইরে থাকবেন বলে জানা গেছে।
ভারতের কর্মকর্তারা জানান, ভিসার সংখ্যা বাড়ানোর পাশাপাশি এটা নিশ্চিত করাও জরুরি হয়ে উঠেছে— প্রকাশ্যে ভারত-বিরোধী অবস্থান নেওয়া কেউ যেন সহজে ভিসা না পান। যদিও বছরে বিপুলসংখ্যক আবেদনকারীর সোশ্যাল মিডিয়া যাচাই করার মতো পর্যাপ্ত জনবল ও প্রযুক্তি ভারতের আছে কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
তবে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ধাপে ধাপে এই প্রক্রিয়া ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় জনবল ও কারিগরি সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। আপাতত বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না দিলেও নীরবেই নতুন এই নীতি কার্যকর করা হচ্ছে বলে ইঙ্গিত মিলেছে।
এম.কে

