ইউক্রেনে সম্ভাব্য শান্তিরক্ষা বাহিনী নিয়ে মন্তব্য করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। তার বক্তব্যে ব্রিটিশ সেনাদের প্রতি অসম্মান দেখানোর অভিযোগ তুলেছেন যুক্তরাজ্যের বিরোধী দলীয় রাজনীতিকরা।
ভ্যান্স বলেন, ইউক্রেনের অর্থনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগই দেশটির নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হতে পারে, যা ‘২০ হাজার সৈন্য মোতায়েনের চেয়েও ভালো, বিশেষ করে যদি সেই সৈন্যরা এমন কোনো দেশের হয় যারা গত ৩০-৪০ বছরে যুদ্ধে অংশ নেয়নি।’
তার এই মন্তব্যের পর যুক্তরাজ্যের বিরোধী দলের নেতারা কড়া সমালোচনা করেন। তবে ভ্যান্স পরে ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, তিনি যুক্তরাজ্য বা ফ্রান্সের কথা বলেননি এবং উভয় দেশই গত ২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স জানিয়েছে, ইউক্রেনে শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে তারা সেখানে সৈন্য পাঠাতে প্রস্তুত।
তবে ভ্যান্স ঠিক কোন দেশকে ইঙ্গিত করেছেন, তা স্পষ্ট করেননি। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তিনি বলেন, ‘অনেক দেশ রয়েছে যারা প্রকাশ্যে বা গোপনে সমর্থন দিচ্ছে, কিন্তু যাদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা কিংবা প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জাম নেই, যা কোনো গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে পারে।’
এ পর্যন্ত কেবল যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স প্রকাশ্যে ইউক্রেনে সম্ভাব্য শান্তিচুক্তির অংশ হিসেবে সৈন্য মোতায়েনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। যদিও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার আগেই বলেছিলেন, বেশ কয়েকটি দেশ এ বিষয়ে সম্মত হয়েছে।
ভ্যান্সের এই মন্তব্য এসেছে এমন এক সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের সামরিক সহায়তা স্থগিত রেখেছে। গত সপ্তাহে হোয়াইট হাউসে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও ভ্লাদিমির জেলেনস্কির মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
জেলেনস্কি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ ভাগাভাগি করার বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরের আগেই হোয়াইট হাউস ত্যাগ করেন।
এ প্রসঙ্গে ভ্যান্স ফক্স নিউজকে বলেন, ‘আমেরিকানদের ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে অংশীদারিত্ব দেওয়াই সবচেয়ে ভালো নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। এটি ২০,০০০ সৈন্য মোতায়েনের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর, বিশেষ করে যদি সেই সৈন্যরা এমন কোনো দেশের হয় যারা গত ৩০-৪০ বছরে যুদ্ধে অংশ নেয়নি।’
স্টারমার মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা—যেমন আকাশ প্রতিরক্ষা সহায়তা—প্রয়োজন হবে, যেন ভ্লাদিমির পুতিন আবার ইউক্রেনে হামলা চালাতে না পারেন।
তবে ট্রাম্প এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতি দেননি। বরং তিনি যুক্তি দিয়েছেন, ইউক্রেনে মার্কিন কোম্পানিগুলোর খনিজ সম্পদ চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের কর্মীদের উপস্থিতি থাকলে সেটাই নিরাপত্তার নিশ্চয়তা হিসেবে কাজ করবে।
ভ্যান্সের মন্তব্যের পর ব্রিটিশ রাজনীতিকরা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কনজারভেটিভ পার্টির ছায়া প্রতিরক্ষা সচিব জেমস কার্টলিজ বলেন, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স দীর্ঘদিন ধরে মার্কিন বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছে। তাদের এই অবদানকে অগ্রাহ্য করা অসম্মানজনক।
ফ্রান্সের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেবাস্তিয়ান লেকোর্নু বলেন, ভ্যান্স তার বক্তব্য সংশোধন করলেও ফরাসি সেনাদের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করাতে হবে। ফরাসি সংসদে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি প্রয়াত ফরাসি সৈন্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান এবং মিত্রদের কাছ থেকে যথাযথ সম্মান পাওয়ার কথা উল্লেখ করেন। তার এই বক্তব্যের পর ফরাসি সংসদ সদস্যরা হাততালি দিয়ে সমর্থন জানান।
যুক্তরাজ্যের লিবারেল ডেমোক্র্যাট দলের প্রতিরক্ষা বিষয়ক মুখপাত্র হেলেন ম্যাগুয়ের, যিনি রয়্যাল মিলিটারি পুলিশের ক্যাপ্টেন হিসেবে ইরাকে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বলেন, ভ্যান্সের মন্তব্য স্পষ্টভাবে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের প্রতিই ছিল এবং এটি অত্যন্ত অসম্মানজনক।
ব্রিটিশ সংসদ সদস্য ও সাবেক সেনা কর্মকর্তা বেন ওবেসে-জেক্টি বলেন, নতুন মার্কিন ভাইস-প্রেসিডেন্টের মন্তব্য ব্রিটিশ সেনাদের আত্মত্যাগকে অসম্মান করেছে, যা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেন, ভ্যান্স যদি যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সকে বোঝাননি, তবে তিনি আসলে কোন দেশের কথা বলেছেন তা পরিষ্কার করা উচিত।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী কোনো মন্তব্য করতে চাননি, তবে তার দপ্তর থেকে জানানো হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী ব্রিটিশ সেনাদের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধাশীল, বিশেষ করে যারা ইরাক ও আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালন করেছেন।
২০০১ সালের ৯/১১ হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্রিটেন ও ফ্রান্স আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান পরিচালনা করে। গত ২০ বছরে দেড় লাখের লাখের বেশি ব্রিটিশ সেনা সেখানে দায়িত্ব পালন করেছেন এবং ২০২১ সালে তারা পুরোপুরি প্রত্যাহার হন। এছাড়া, ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধেও যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশ নেয়, যেখানে একসময় ৪৬ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য মোতায়েন ছিল।
সূত্রঃ বিবিসি
এম.কে
০৫ মার্চ ২০২৫