বাংলাদেশে অতিসম্প্রতি গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতা হারানো দল আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তাদের একজন বলেছেন, ‘আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারব না’। আরেক জন বলেছেন, ‘আমি আত্মগোপনে আছি, ফোনে কথা বলতে পারি’, অপর একজন বলেছেন, ‘নিরাপদ কোনো স্থানে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করব’ এবং অন্য এক নেতা বলেছেন, ‘আপনার গতিবিধি নজরদারি করা হবে, তাই আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে পারব কি না জানি না।’
এই নেতারা ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে জানিয়েছেন, তারা বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর প্রতিশোধের শিকার হওয়ার শঙ্কায় আত্মগোপন করেছেন। এই নেতাদের সঙ্গে কথা বলার সময় একটি অভিন্ন সুর পেয়েছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তাদের মতে, ‘শেখ হাসিনা দল ও জনগণকে পরিত্যাগ করেছেন।’ তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘আপা (হাসিনা) আমাদের ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। এটা হয়েছে কফিনে শেষ পেরেকঠোকা অবস্থা।’
আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, পুলিশের নিষ্ঠুরতায় জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা বুঝেছিলাম। বিএনপিকে নির্বাচনের তরী ওঠানো গেলে হয়তো সেই ক্ষোভ থামানো যেত। তাতে আমরাই আবার জিতে ক্ষমতায় থাকতে পারতাম।
দলীয় নেতা–কর্মীদের পরিত্যাগ করে শেখ হাসিনার চলে যাওয়ায় পর একই অনুভূতি প্রকাশ করেছেন এবং করছেন আরও অনেকে। তাদের দাবি, ৫ আগস্টের ঘটনাবলি তারা আগে থেকে টের পাননি। সেদিন শেখ হাসিনা তার বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ ছেড়ে ভারত পালিয়ে যান। শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ ভারতে অবস্থান করছেন।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত তার মন্ত্রিসভার সদস্য, এমনকি ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরও পুরোপুরি বিস্মিত করেছে। এক নেতা বলেন, ‘আমরা টেলিভিশনের খবর থেকে এটা জানতে পেরেছিলাম। এতেই আমাদের মন ভেঙ্গে যায়।’
সবকিছু ফেলে এভাবে শেখ হাসিনার প্রস্থান আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের জীবন বিপদের মধ্যে ফেলেছে। ‘বিক্ষোভকারী, বিএনপি—জামায়াতের কর্মী ও সুযোগসন্ধানীরা’ আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়িঘর, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও দলীয় কার্যালয়গুলো লক্ষ্য করে হামলা চালায়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, ‘ (৫ আগস্ট শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর) আমরা একটা সময়ই শুধু বাড়ি থেকে বের হওয়ার সুযোগ পাই। সেটি সেনাপ্রধান যখন বেলা তিনটার দিকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ও মানুষ তা শুনতে টেলিভিশনের পর্দায় নজর রাখছিল।’ আরেক নেতা ও লীগ সরকারের সাবেক মন্ত্রী বলেন, ‘আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা ধরা পড়লে লোকজন আমাদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারত।’
আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনার সরকার বিরোধী দলের নেতাদের নিশানা করে, কারাগারে পাঠায়, মারধর করে, ভয়ভীতি দেখায় ও হয়রানি করে। কিন্তু পরে হঠাৎই পরিস্থিতি উল্টে যায়।
সাম্প্রতিক ঘটনার (শেখ হাসিনার পতন ও দেশত্যাগ) খানিকটা পেছনে তাকালে দেখা যাবে, ঘটনাপ্রবাহে কেউ কেউ (হাসিনা সরকারের) বিশেষ করে গত জুলাইয়ে শিক্ষার্থী ও বিক্ষোভকারীদের উপর গুলি চালানোর ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। পরে ৩–৪ আগস্ট ছাত্র–জনতা রাস্তায় নেমে আসে। ৫ আগস্ট বিক্ষোভকারীরা কারফিউ ভাঙে। সেদিনই সরকারের পতন ঘটে।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের জন্য আত্মগোপনে থাকা ওই নেতাদের একজন দলের অভ্যন্তরীণ একটি স্বার্থন্বাষীগোষ্ঠীকে দায়ী করে বলেছেন, ‘তিনি (শেখ হাসিনা) আমাদের কথা শোনেননি।’ এই গোষ্ঠীকে ‘গ্যাং অব ফোর’ বলে আখ্যায়িত করেন নেতাদের একজন। তিনি বলেন, গোষ্ঠীটি শেখ হাসিনাকে বাস্তব অবস্থা বুঝতে দেয়নি।
এই চার নেতা হলেন শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ (জয়), বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।
আওয়ামী লীগের ওই নেতা বলেন, ‘চারজনের এই দল তার (হাসিনা) পতনের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করেছে। এই ব্যক্তিদের ওপর তার ছিল অন্ধবিশ্বাস। তার যে সহজাত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল, তা তিনি তাদের কারণে হারিয়েছেন।’
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিকে না আনা শেখ হাসিনার একটি ‘বড় ভুল’ হিসেবে বর্ণনা করা হচ্ছে। সূত্রগুলো বলেছে, আওয়ামী লীগের কিছু নেতা মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে লন্ডনে বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন।
একটি সূত্রের ভাষ্য, ‘আড়ালে থাকা একটি চ্যানেলের মাধ্যমে প্রস্তাবও দেওয়া হয় (বিএনপিকে নির্বাচনে আনার)। আমাদের ধারণা, তারেকের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় চ্যানেলটি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের এক বছর আগেই ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে প্রতিষ্ঠা করা হয় কিন্তু শেখ হাসিনা ওই প্রস্তাবে সবুজ সংকেত দেননি।’
আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার বিষয়টি শেখ হাসিনার প্রত্যাখ্যান করা ছিল ‘সাংঘাতিক ভুল’। কেননা, একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। বিএনপিকে নির্বাচনে আনা গেলে বিরোধীদের রাগ–ক্ষোভ হয়তো মিটে যেত।
ওই নেতা আরও বলেন, ‘দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, নির্যাতন, পুলিশের নিষ্ঠুরতায় জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে, তা আমরা বুঝছিলাম। বিএনপিকে নির্বাচনী তরীতে উঠানো গেলে সেই ক্ষোভ হয়তো থামানোও যেত। তাতে আমরাই আবার জিততে পারতাম এবং দল ক্ষমতায় থাকত।’
নেতা–কর্মীরা মনে করেন, বিশেষ করে গত জানুয়ারির নির্বাচনে জেতার পর শেখ হাসিনা আরও একগুঁয়ে হয়ে উঠেন ও কোনো পরামর্শ শোনেননি। এ প্রসঙ্গে ওই নেতা বলেন, ‘টানা চতুর্থবার জিতে তিনি (হাসিনা) অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং কোটা সংস্কার নিয়ে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলনে সৃষ্ট ক্ষোভের মাত্রা বুঝতে ব্যর্থ হন।’
সূত্রগুলো বলেছে, কৌশলে কিছু নেতা শেখ হাসিনাকে জুলাইয়ের শুরুতে ছাত্র বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনায় বসার আহ্বান জানান। তবে তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। (হাসিনা সরকারের) কফিনে শেষ পেরেকটি বসে তখন, যখন একই মাসে পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্যরা ছাত্রনেতাদের তুলে নিয়ে যান এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে ও আন্দোলন কর্মসূচি প্রত্যাহারে জোরপূর্বক প্রতিশ্রুতি আদায় করে ছেড়ে দেন।
এ কৌশল হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। কর্মসূচি প্রত্যাহারে কীভাবে জোরপূর্বক প্রতিশ্রুতি আদায় করা হয়েছে, ছাত্রনেতারা সেই বিষয় জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন। এটি পরপর কিছু ঘটনার সূত্রপাত ঘটায় এবং শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হন। শেখ হাসিনার পতনের পর জীবনাশঙ্কায় আওয়ামী লীগের অনেক নেতা–কর্মী ও বুদ্ধিজীবী দেশজুড়ে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেন।
আশ্রয় নেওয়া এই ৬২৬ জনের মধ্যে ছিলেন নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতা, ৫ জন বিচারক, বেসামরিক প্রশাসনের ১৯ কর্মকর্তা, ২৮ পুলিশ কর্মকর্তা, বিভিন্ন পদের ৪৮৭ জন পুলিশ সদস্য, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাসহ নানা পেশার ১২ জন ও ৫১টি পরিবার। ঘটনাচক্রে দেশ ছেড়ে পালানোর চেষ্টাকালে আটক হন শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
শেখ হাসিনার দেশত্যাগের সঙ্গে সঙ্গে তার দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা আত্মগোপন করেছেন, কেউ গ্রেপ্তার হয়েছেন। নেতারা বলছেন, ৭৫ বছরের পুরোনো যে দল টানা ১৫ বছরের বেশি দেশ শাসন করেছে, তারাই এখন অস্তিত্ব সংকটে।
এদিকে দল গোছানোর ক্ষেত্রে ভবিষ্যতের প্রথম পদক্ষেপ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের নেতাদের একজন বলেন, ‘দলকে পুনর্গঠনে তাকে (হাসিনা) তৃণমূল পর্যায়ের লোকজন বাছাই করতে হবে, তাদের মধ্যে থাকবেন কিছু তরুণ আওয়ামী নেতা; মাঠপর্যায়ে যাদের ব্যাপারে মানুষের আস্থা আছে, লোকজনের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ আছে এবং অবশ্যই পরিবারের (হাসিনা) প্রতি অনুগত। এ যাত্রা দীর্ঘ হবে।’
এ নেতা আরও বলেন, ‘আমাদের শক্ত ঘাঁটি ও কর্মীবাহিনী আছে। অনেকে বিপথগামী হয়েছেন, যেমনটা ঘটেছে সুবিধাবাদীদের ক্ষেত্রে। সমর্থকদের মধ্যেও এমনটা থাকবে। কিন্তু আমাদের অন্তত এমন কিছু ব্যক্তি বা গোষ্ঠী থাকা দরকার; যারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করবে ও নির্বাচন যখনই হোক, তাতে অংশ নেবে। এখন এটাই প্রয়োজন।’
এ পরিস্থিতিতে দলের হাল ধরার বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, রুহুল কবির রিজভীর মতো কয়েকজন নেতার ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করেন তিনি। বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকাকালে ও তারেক রহমান বিদেশে অবস্থানকালে বিএনপির দুর্গ সামলেছেন তারা। আওয়ামীলীগের এইরকম কোনো নেতা কি আদৌ আছে?
দেশে শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগবিরোধী মনোভাব বিরাজ করায় শেখ হাসিনার পরিবার ও এর উত্তরসূরি সজীব ওয়াজেদ জয়ের খুব কম বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া উচিত বলে মনে করেন দলটির নেতারা।
আওয়ামী লীগের নেতাদের একজন বলেন, ‘লোকজন এখনো ক্ষেপে আছেন। আমাদের পক্ষ থেকে তাদের সময় দিতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার বা বিএনপি কিংবা জামায়াতের নেতৃত্বাধীন সরকার যে–ই কয়েকটা বছর ক্ষমতায় থাকুক, আমাদের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা আছে। কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে আমাদের আবার সংগঠিত হওয়ার কথা ভাবতে হবে।’
সূত্রঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস
এম.কে
২২ আগস্ট ২০২৪