অনিয়মিত পথে আসা একজন বাংলাদেশিকে ফেরত নেয়া হলে, বিনিময়ে অপর একজন বাংলাদেশিকে নিয়মিত পথে আসার আসার সুযোগ দেবে ইটালি৷ ইউরোপের দেশটি বাংলাদেশকে এমন প্রস্তাব দিয়েছে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস৷
এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনাটি চলমান রয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা৷ মঙ্গলবার ইটালির রাজধানী রোমের একটি হোটেলে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এসব কথা বলেন৷
এর আগের দিন সোমবার ইটালির রাজধানী রোমের মেয়র রবার্তো গুয়ালতিয়েরির সঙ্গে তার কার্যালয়ে দেখা করেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা৷
সেই সাক্ষাত প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, রোমের মেয়র ‘‘অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে বলেছেন যে আপনারা খুব মূল্যবান তার জন্য৷ এই শহরের একটা মূল্যবান অংশ আপনারা কন্ট্রিবিউট করছেন এবং আপনাদের কঠিন পরিশ্রমের মাধ্যমে রোম শহরের যে উন্নতি হচ্ছে সেটা বারে বারে উনি উল্লেখ করেছেন৷ এবং আপনাদের পরিশ্রম, আপনাদের মেধা, আপনাদের সৃজনশীলতা—এগুলোর খুব প্রশংসা করেছেন৷’’
ইটালিতে বসবাসতরত বাংলাদেশিদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে অবগত জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, সেসব বিষয় নিয়ে রোমের মেয়রের সঙ্গে কথা হয়েছে৷
তিনি বলেন, ‘‘ভিসার কথা বললাম৷ এই যে লোক বের করে দেয়া হচ্ছে, সেগুলো বললাম৷ যাদের ভিসা দেওয়া হয়েছিল, এখন ভিসা রিনিউ করা হচ্ছে না, সেগুলোর কথা বললাম৷’’
জবাবে ইটালির রাজধানী রোমের মেয়র কী উত্তর দিয়েছেন, তা নিয়েও প্রবাসীদের সামনে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা৷ তিনি বলেন, ‘‘(মেয়র বলেছেন) বাংলাদেশি যারা আছেন, তারা ইটালির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷ এটা এমন না যে আমরা তাদের থেকে নিষ্কৃতি পেলে বাঁচি৷ আমরা তাদের রাখতে চাই, এটা পরিষ্কার৷ সম্মানের সঙ্গে রাখতে চাই৷’’
কিন্তু এতে কিছু সমস্যা আছে বলেও প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন রোমের মেয়র রবার্তো গুয়ালতিয়েরি৷ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘ভেজাল, এই বাংলাদেশ যেখানে যাচ্ছে ভেজালের একটা সৃষ্টি করছে৷ এটা থেকে আমরা বাঁচতে পারছি না৷ এটা থেকে নিষ্কৃতি কীভাবে? আমি বললাম যে আমরা দুই পক্ষ চেষ্টা করি, আমাদেরও কষ্ট হয়৷ তারাও (বাংলাদেশি অভিবাসী) কষ্ট পায়, আমরাও কষ্ট পাই৷ তারা (বাংলাদেশি অভিবাসী) ঠেকায় পড়ে এসবের মধ্যে পড়ে গেছে, এমন না যে তারা আসলে দুষ্ট লোক৷ তারা ভালো লোক, কিন্তু পরিস্থিতির কারণে দুষ্টুমি করে টিকে থাকতে হচ্ছে তাদেরকে৷ দুষ্টুমি করে যাতে টিকতে না হয় সে জন্য একটা পন্থা বের করতে হবে আমাদের৷’’
সমাধান হিসাবে ইটালির পক্ষ থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি৷ অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘‘এখন বলছে যে, একজন যদি নিয়ে যাও, আমরা একজন নতুন আনবো৷’’
তিনি আরো বলেন, ‘‘একজন ভেজাল লোক অদলবদল করে জিনিসটা পরিষ্কার হয়ে যাক৷ অর্থাৎ জিনিসটা পরিষ্কার৷ তাদেরও ইচ্ছা পরিষ্কার, আমরাও চাই যে পরিষ্কার৷ এখন একজনের পরিবর্তে একজন হবে, নাকি একজনের পরিবর্তে দুই জন হবে, এগুলো নিয়ে আমরা একটু আলাপ করছি যে কী করা যায়৷ এটা থেকে নিষ্কৃতি পেতে হবে, উপায় নেই আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে৷ বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে তাদেরকে এটা করতে হয়৷’’
ইটালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত দেশটিতে অনিয়মিত পথে আসা আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা ৫৪ হাজার ৩৮০৷ এদের মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৬ হাজার ১৭৫ জন হলেন বাংলাদেশি নাগরিক৷ দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা মিশরীয়দের সংখ্যা সাত হাজার ৪৫৯৷ এর পরেই রয়েছে ইরিত্রিয়া, পাকিস্তান ও সুদানের নাম৷
অনিয়মিত পথে আসা বাংলাদেশিদের প্রসঙ্গ ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘এই যে নানাভাবে আসেন, তাদের সঙ্গেও আমার আলাপ হয়েছে৷ জাহাজ থেকে সদ্য নামা লোকের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে৷ মেয়রকে নিয়েও আলাপ হয়েছে৷ কী করবে এখন, এরা তো এসে গেছেন৷ মেয়র বললেন যে ঠিক আছে৷ এসে যখন গেছে, আমাদের দায়িত্ব হলো তাদের গ্রহণ করা৷ তাদের এখানে সেটেল করা৷ তাদের (ইটালির) অ্যাটিটিউড দেখলাম যে এরকম না, এক্ষুণি জাহাজে উঠো, ফেরত যাও৷ ওরকম বলেনি৷ ওরকম বলে না তাদের৷ এটাই ভালো লাগে যে, এরা সম্মান করে, মানবিকতা আছে৷’’
একজনের পরিবর্তে একজন হবে, নাকি একজনের পরিবর্তে দুই জন হবে, এসব নিয়ে আলোচনা চলমান রয়েছে বলেও জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা৷
কিন্তু বাংলাদেশিরা ইটালিতে এসে থাকতে চান না বলেও প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন ইটালির মেয়র রবার্তো গুয়ালতিয়েরি৷ এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘মেয়র বললেন, এরা এখানে থাকবে না তো৷ আমি বললাম, কেন? বললেন, তাদের ডেসটিনেশন হলো অন্য দিকে৷ আরো উত্তরে যাবে৷ উত্তরে যেতে যেতে কদ্দুর যাবে, সেটা তারাই জানেন৷ কিন্তু এখানে বেশিদিন থাকেন না৷’’
সমস্যা সমাধানে আলাপ চলমান রয়েছে জানিয়ে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘‘একটা তো হলো ভেজাল লোক, ঢুকে গেছে কাগজপত্র কিছু নেই৷ ভেজালের মধ্যে আছে৷ ওদেরকে কীভাবে সঠিক পথে নিয়ে আসা যায়৷ অর্থাৎ চেষ্টা হচ্ছে সমাধান করা৷ তাড়িয়ে দেওয়াটা সমাধান না৷ এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে৷ দুই পক্ষেই এটা পরিষ্কার, তাড়িয়ে দেওয়াটা সমাধান না৷’’
ইটালির ডানপন্থি প্রধানমন্ত্রী জর্জা মেলোনির সঙ্গে কয়েক দফা সাক্ষাৎ হওয়ার কথাও জানান মুহাম্মদ ইউনূস৷ তিনি বলেন, ‘‘তিন বার দেখা হয়েছে৷ চতুর্থ বার আবার দেখা হবে ডিসেম্বরে৷ উনি বাংলাদেশে আসবেন তখন৷ কয়েকদিন আগেই দেখা হয়েছে৷ সেটা হলো নিউইয়র্কে৷’’
মানবপাচার ঠেকাতে সরকারের তৎপরতা প্রসঙ্গে কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা৷ তিনি বলেন, ‘‘হিউম্যান ট্রাফিকিং যে জিনিসটা বলে, আপনারা সবাই পরিচিত আছেন, মস্ত বড় জিনিস, বহুলোক প্রাণ দেয় ইত্যাদি৷ এগুলো যাতে দিতে না হয় সেটার চেষ্টা করা৷ যেহেতু তাদের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্ক আছে, এটা বহুবার বুঝিয়েছি যে জিনিসটা যাতে হয়, সুন্দরভাবে হয় এবং আপনারা যাতে বিভিন্ন পেশায় প্রতিষ্ঠিত হন৷’’
রোম শহরের বিভিন্ন প্রান্তে বাংলাদেশিরা আছে জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘রোম শহরের কোনো রেস্টুরেন্ট নেই, যেখানে বাংলাদেশি শেফ নেই৷ বাংলাদেশি শেফ চলে গেলে, রোম শহর অচল হয়ে যাবে৷’’
এসময় প্রবাসীদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘‘অভ্যুত্থানের সময় আমরা যে সরকার পেলাম, যে অবস্থা পেলাম—এটা লন্ডভন্ড অবস্থা৷ টাকা-পয়সা সব খালি৷ চলাফেরা, বেতন দেবার উপায় নেই৷ মানুষের টাকা পরিশোধ করার উপায় নেই৷ আন্তর্জাতিক (ঋণ) পরিশোধ করার উপায় নেই৷ একদম তলানিতে আমরা৷’’
তখন রেমিট্যান্সের উপরই আস্থা রেখেছিলেন বলে জানান মুহাম্মদ ইউনূস৷ তিনি বলেন, ‘‘এই রেমিট্যান্স না হলে এই সরকার টিকে থাকা বড় মুশকিল হতো৷’’
ইটালির রোমে দুই দিনের সফর শেষে দেশে ফিরেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস৷ বুধবার সকাল ৮টা ২০ মিনিটে তাকে বহনকারী বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের ফ্লাইটটি রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেছে৷
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) আয়োজিত বার্ষিক ওয়ার্ল্ড ফুড ফোরামে অংশ নিতে গত রোববার (১২ অক্টোবর) স্থানীয় সময় বিকেল ৫টার দিকে ইটালির রাজধারী রোমে পৌঁছান অধ্যাপক ইউনূস৷
সূত্রঃ ইনফোমাইগ্র্যান্টস
এম.কে
১৬ অক্টোবর ২০২৫