আওয়ামী লীগ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কিছু নেতাকে চাঁদা না দেয়ায় ইউনাইটেড এয়ার চালু করতে দেয়া হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ (বিডি) লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে একশ কোটি দিলেই এয়ার চালু করে দেয়া হবে। আর চাঁদা না দেয়ায় এক পর্যায়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে পুলিশের আইজি দিয়ে তারা আমাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেলে দেশে ফেরেন ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী।
ফিরেই গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম ব্যক্তিগতভাবে একশ কোটি টাকা দাবি করেন। না দেয়ায় প্রচণ্ড খারাপ আচরণ করেন এবং মাত্র ৫ মিনিটের আলোচনায় তিনি পর্ষদ থেকে আমাকে বের করে দেয়ার হুমকি দেন, পরে তা করেনও।’
বাংলাদেশের ইতিহাসে ২০১১ সালে প্রথম লন্ডন টু সিলেট সরাসরি বিমান ফ্লাইট চালু করে ইউনাইটেড এয়ার। সে সময়ে নিজের টাকায় কেনা এয়ারলাইন্সে চড়ে গর্বের সঙ্গে দেশে আসতেন বিনিয়োগকারী ও প্রবাসী বাঙালীরা।
প্রবাসীদের টাকায় কেনা ১০টি উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হলেও ২০১৬ সাল থেকে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বিমানগুলো। বছরে ১২ লাখ আরোহীকে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর হাজার কোটি টাকা রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ। যার বেশির মুনাফা এখন লুফে নিচ্ছে বিদেশি এয়ার লাইন্সগুলো।
রাজধানীর উত্তরায় নিজ বাসায় সম্প্রতি ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ বলেন, ‘ইউনাইটেড এয়ার বন্ধ হওয়ার পরে প্রস্তাব আসছে- ব্যক্তিগতভাবে একশ কোটি টাকা দিলে চালু করার ব্যবস্থা করে দেবে। আইসিবির মাধ্যমে ২২৪ কোটি টাকা তোলার প্রক্রিয়া ছিল, সেও বন্ধ করে দেয়। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারেরমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বলেছিলেন, তাকে মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। তিনি বলেছেন, আওয়ামী লীগের বড় বড় অনেকে এটাতে জড়িত- আপনি তাদের ম্যানেজ করেন। তাহলে সিভিল এভিয়েশনের উচ্চ পর্যায়ে যারা আছেন তারা সবাই আপনাকে সহযোগিতা করবেন।’
‘ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ যখন লাইম লাইটে আসছে, তখন আওয়ামী লীগের বিভিন্ন নেতার রিকোয়েস্ট আসছে। চাঁদার দাবি আসছে- এগুলো আমরা দিতে পারি নাই। প্রবাসীদের আয়ের উৎস থেকে এই এয়ার। তাদের আয়ের টাকা দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। একপর্যায়ে তারা আমাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য করে। পুলিশের আইজি দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে- আমি তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে চাই।’
আদালত ছাড়া দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা বিএসইসি দিতে পারে কি না জানতে চাইলে বিএসইসির মুখপাত্র ফারহানা সিদ্দিকী বলেন, ‘আদালত ছাড়া বিএসইসি কোন নাগরিকের দেশ ত্যাগের নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে না। আপাতত আমরা ১২টি বিষয়ে অনুসন্ধান করছি। তার মধ্যে এটিও থাকলে অবশ্যই বিএসইসি আমলে নেবে এবং অপরাধগুলো অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে বলবে।’
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউনাইটেড এয়ারের পুনর্গঠিত পর্ষদ থেকে ৫ জনের পদত্যাগ করেছেন। সে সম্পর্কে ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী বলেন, ‘আমার প্রতিষ্ঠানের যিনি কর্মরত ছিলেন, কোম্পানি সেক্রেটারি এবং বিজনেস ডেভলপমেন্টকারী; অসৎ একটা লোককে পরবর্তীতে ম্যানেজিং ডিরেক্টর বানানো হয়েছে। তারা এখন লুটপাট করছে। তারা প্লেনের যন্ত্রাংশ খুলে-খুলে বিক্রি করছে।
সাবেক সিভিল এভিয়েশন, সাবেক কমিশন এবং সাড়ে তিন বছর ধরে টেকওভার করা পর্ষদ সম্মিলিতভাবে লুটপাট করছে। তারা প্রাইস সেনসিটিভ ইস্যু নিয়ে শেয়ার ব্যবসা করে বাণিজ্য করেছে- ইনভেস্টিগেশন করলেই সব বেরিয়ে আসবে। তারা ১৮ মাস আমার অফিস ব্যবহার করেছে কিন্তু কোন বিল দেয়নি। তাদের আইনের আওতায় নেয়া হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমি কোন দল করিনা। অথচ আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে ‘নন কমপ্লাস’ অভিযোগ তুলে সব সুবিধা বন্ধ করে দেয়। একদিকে বৈষম্যের শিকার, অন্যদিকে আওয়ামী সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেতাদের নীতিহীন সেচ্ছাচারিতা। যার ফলে ২০১৬ সালে চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয় এয়ার লাইন্সটি।’
এয়ারক্রাফট বাতিল ও পুনরুজ্জীবিত করা সম্পর্কে ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ বলেন, ‘প্রত্যেক এয়ার ক্রাফটের লাইফ লিমিটেশন থাকে। এসব এয়ার আবার চালু করা যাবে। হয়তো ৪০-৫০ পার্সেন্ট টাকা বাড়তি লাগবে। এগুলোর সি’চেক করলেই লাইফ ফিরে আসে। আর সিভিল এভিয়েশনে এটার ই-ভ্যালুশেন শেষে তবেই তো এয়ার রান করবে। জাঙ্ক হয়েছে বলে আমি মনে করি না। যার এবিষয়ে অভিজ্ঞতা নেই- সে বললেই বিশ্বাস করবো; এটা নয়।’
দেশিয় এয়ার টিকে থাকা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘প্রথম; পরিচালকদের সম্মিলিতভাবে ৩০ শতাংশ এবং ব্যক্তি উদ্যোক্তাদের ২ শতাংশ শেয়ার ধারণে গ্রেডিং করতে হবে। কারণ এতোবেশি টাকা একজন বিনিয়োগকারীর নেই। দ্বিতীয়ত; সারচার্জ কমাতে হবে। পৃথিবীর কোন দেশে সারচার্জ ৭২ শতাংশ নেই। আর সিভিল এভিয়েশনের কাছে ঋণ মাত্র ৫৬ কোটি টাকা আমরা দিতে চাই। সারচার্জসহ মোট বকেয়া প্রায় ৩৫৫ কোটি। একটা এয়ার কোম্পানি ফাংশনেবল নেই, তাকে উঠে আসতে সরকারকে চার্জ মওকুফ করা দরকার।
সিভিল এভিয়েশনের সহযোগিতায় নতুন কিছু ডমেস্টিক এয়ার নিয়ে এসে শুরু করতে চাই। তারা অন্যকে দিয়েও করতে পারে, আমার সহযোগিতা চাইলে আমি করবো। তাহলে এয়ারগুলো আবার সচল হবে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো সচল করা সম্ভব হবে’ বলেন ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ।
১ লাখ ৬২ হাজার বিনিয়োগকারীর স্বার্থে অন্তর্বর্তী সরকারের নীতি সহায়তা কামনা করেন ক্যাপ্টেন তাসবিরুল আহমেদ চৌধুরী।
এম.কে
১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪