অনেক যুক্তরাজ্যের গৃহকর্মীরা, আয়া বা গৃহস্থালির কাজে নিয়োজিত আছেন। যারা মনে করেন তারা আধুনিক দাসত্বের শিকার। যুক্তরাজ্যে ন্যাশনাল রেফারেল মেকানিজম কার্যক্রমের অধীনে গৃহকর্মীদের সুরক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে বলে জানা যায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমে।
এই কার্যক্রমের অধীনে যুক্তরাজ্যে বসবাসরত নির্যাতনের শিকার বিদেশি গৃহকর্মীরা ‘আধুনিক দাসত্ব’ থেকে সুরক্ষা চাইতে পারেন৷ যেসব অভিবাসী গৃহকর্মী ভিসায় (ও.ডি.ডব্লিউ.ভি) দেশটিতে আসেন এবং নিয়োগকারীর অবমাননাকর আচরণের শিকার হন তাদের সহায়তায় সরকারের ‘ন্যাশনাল রেফারেল ম্যাকানিজম’ বা এন.আর.এম. নামে একটি কার্যক্রম রয়েছে৷
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের একটি প্রতিবেদনে জানা যায় মানবপাচার, দাসত্ব বা জোরপূর্বক শ্রমের মতো শোষণমূলক আচরণকে আধুনিক দাসত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ আধুনিক দাসত্বের শিকার গৃহকর্মীদের অনেকে অভিযোগ করেন তাদেরকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অথবা প্রতারণার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে নিয়ে আসা হয়৷
কাজের সময়সীমা না থাকা, মজুরি আটকে রাখা, কারো তত্ত্বাবধানে ছাড়া বাইরে যেতে না দেয়াসহ নানা অবমাননাকর পরিস্থিতিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন নির্যাতিতরা৷ কিছু ক্ষেত্রে পাসপোর্ট বা মোবাইল ফোন কেড়ে নেয়া, যথেষ্ট খাবার না দেয়া এবং মৌখিক, মানসিক, শারীরিক বা যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনাও জানা যায়৷
আধুনিক দাসত্বের শিকার হিসেবে এন.আর.এম. এর সুরক্ষার জন্য বিবেচিত হতে হলে গৃহকর্মীর আবেদেনটি ‘ফার্স্ট রেসপন্ডার অর্গানাইজেশনের’ সংস্থার মাধ্যমে আসতে হয় বলে জানান এন.আর.এম এর একজন কর্মকর্তা।
ফিলিপিনো ডমেস্টিক ওয়ার্কার্স অ্যাসোসিয়েশন নামের একটি সংগঠনের সহায়তা নেয়া ফিলিপিন্সের একজন গৃহকর্মী জানান, ২০১৮ সালে কাতার হয়ে যুক্তরাজ্য আসেন তিনি৷ তাকে চাকরিদাতার দুইটি বাড়ি পরিষ্কার করতে হতো৷
তিনি বলেন, ‘‘আমার কোন ছুটির দিন ছিল না৷ সাত দিন, ২৪ ঘণ্টাই কাজ করতাম আমি৷’’ স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি মেঝেতে ঘুমাতাম৷ আমার খাওয়ার জন্য অবশিষ্ট থাকতো বড়জোর রুটি, ডিম আর পানি৷’’
২০১৯ সালে নির্যাতনকারী চাকরিদাতার কাছ থেকে পালিয়ে আসেন তিনি৷ আধুনিক দাসত্বের শিকার বিবেচিত হওয়ায় এনআরএম কর্মসূচির সহায়তা পান তিনি৷
ওয়ার্কার এসোসিয়েশনের একজন কর্মকর্তা অ্যাভ্রিল শার্প বলেন, অভিবাসীদের একমাত্র সুযোগ হলো একজন আইনজীবী নিয়োগ দেয়া এবং নির্যাতনকারী নিয়োগকর্তাকে আদালতে হাজির করা৷ যদিও বেশিরভাগ অভিবাসীর পক্ষেই এই খরচ বহন করা সম্ভব হয় না৷
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আবেদনটি আসার পর সাধারণত পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যেই প্রাথমিক সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হয়৷ সেটি ইতিবাচক হতে পারে আবার নেতিবাচকও হতে পারে৷
যাদের আবেদন গৃহীত হয় তারা আইনি সহযোগিতা, থাকার ব্যবস্থাসহ নানা সহায়তা পান৷ স্যালভ্যাশন আর্মি ও অন্য দাতা সংস্থাগুলো সাধারণত এই সেবাগুলো দিয়ে থাকে বলে জানা যায়।
প্রথম ইতিবাচক সিদ্ধান্ত দেয়ার পর এন.আর.এম. এর কাছ থেকে দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে দুই বছর পর্যন্ত সময় লেগে থাকে৷
চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়ার পর নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়৷ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তখন প্রত্যেকের বিষয়গুলো আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখে৷ যেমন, আবেদনকারী যুক্তরাজ্যে অবস্থান, আইনি প্রক্রিয়া, ক্ষতিপূরণ বিষয়গুলোরও সুরাহা করা হয়৷
তবে যুক্তরাজ্যে থাকার অনুমতির জন্য এন.আর.এম.এ চূড়ান্ত সমাধান নয়৷ এর অধীনে সাময়িক বসবাসের অনুমতি মিললেও পুরোপুরি সুরক্ষা বা আশ্রয়ের নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না৷
আধুনিক দাসত্বের শিকাররা আলাদাভাবে আশ্রয় আবেদন করতে পারেন৷ দেশে ফিরে গেলে আবারও পাচার হয়ে দাসত্বের ঝুঁকিতে পড়তে পারেন এমন কারণ দেখিয়ে সাধারণত অনেকেই আবেদন করতে পারেন বলে একজন আইনজীবীর নিকট হতে জানা যায়৷
একজন আইনজীবী বলেন, কেউ যদি তার গৃহস্থালি কাজের ভিসার মেয়াদ পূর্তির ছয় মাস আগে প্রথম সিদ্ধান্তটি পেয়ে থাকেন তাহলে তিনি দ্বিতীয় বা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পাওয়ার আগ পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যেতে পারবেন৷
কিন্তু ভিসার মেয়াদ ছয় মাসের কম থাকলে তিনি এই সময়ে কাজের অনুমতি পাবেন না৷ তাকে পরের সিদ্ধান্ত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে৷
এর ফলে অনেকেই কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন৷ বেশিরভাগ কর্মীরাই অভিযোগ করেন তাদের পক্ষে এই সময় কাজ ছাড়া থাকা প্রায় অসম্ভব৷ বেশ কয়েকজন বিদেশি কর্মী জানিয়েছেন, নিজ দেশে পরিবারের অসুস্থ সদস্যের চিকিৎসা বা সন্তানের পড়াশোনার জন্য তাদেরকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়৷
এই অবস্থায় অনুমতি না থাকলে কোনো অভিবাসীকে কাজে নিয়োগ দেয়া নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের জন্যও কঠিন৷ কেননা এর ফলে বড় অঙ্কের জরিমানার পাশাপাশি কারাদণ্ডও ভোগ করতে হতে পারে৷ অন্যদিকে কাজের অনুমতি না থাকা অভিবাসী আটক এবং অভিবাসন সংক্রান্ত জটিলতার ঝুঁকিতে পড়তে পারেন৷
শার্প জানান এমন প্রেক্ষিতে অনেক অভিবাসী আবারও নির্যাতন ও পাচারের শিকার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েন৷
তিনি বলেন, ‘‘তারা অনেক সময়ই অনানুষ্ঠানিক বা অবৈধ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়াতে বাধ্য হন, যেখানে আবারো তারা প্রতিকূল পরিবেশের মুখোমুখি হন, আর তাদের এই পরিস্থিতির সুযোগে থাকেন শোষণকারী চাকরিদাতারা৷’’