ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশন (ইসিএইচআর) থেকে যুক্তরাজ্যের বেরিয়ে যাওয়া একটি গুরুতর ও ভুল সিদ্ধান্ত হবে বলে সতর্ক করেছেন দেশটির সমতা ও মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ সংস্থার নতুন প্রধান মেরি-অ্যান স্টিফেনসন। তিনি বলেন, অভিবাসন ইস্যুতে ডানপন্থী রাজনৈতিক চাপ প্রশমিত করতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাঠামো থেকে সরে যাওয়া দীর্ঘমেয়াদে পুরো সমাজের জন্য ক্ষতিকর হবে।
ডিসেম্বরে ইক্যুয়ালিটি অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস কমিশনের চেয়ার হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর স্টিফেনসন স্পষ্ট করে জানান, ইসিএইচআর এমন একটি কাঠামোর অংশ যা মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে—যেগুলো অধিকাংশ নাগরিকই স্বাভাবিক ও অপরিহার্য বলে মনে করেন। তবে মানবাধিকার নিয়ে চলমান জনআলোচনায় সত্যতা ও দায়িত্ববোধের ঘাটতি রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
তিনি বিশেষভাবে অভিবাসীদের সমাজের জন্য হুমকি হিসেবে উপস্থাপনের প্রবণতার সমালোচনা করেন। তার মতে, অভিবাসনকে অতিরঞ্জিত ঝুঁকি হিসেবে দেখানোর রাজনীতি শুধু নতুন অভিবাসীদের জীবনই কঠিন করে না, বরং যুক্তরাজ্যে বসবাসরত জাতিগত সংখ্যালঘু নাগরিকদের নিরাপত্তা ও সামাজিক অবস্থানকেও দুর্বল করে দেয়।
স্টিফেনসন বলেন, ইসিএইচআর নিয়ে বিতর্কে প্রায়ই এমন মামলার উদাহরণ তুলে ধরা হয় যেখানে মানবাধিকার যুক্তি আদালতে টেকেনি, অথচ সেগুলোকে ইচ্ছাকৃতভাবে রাজনৈতিক প্রচারণায় ব্যবহার করা হয়। তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণার কথা উল্লেখ করেন, যেখানে গণমাধ্যমের বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদনের একাধিক উদাহরণ তুলে ধরা হয়েছে।
এর মধ্যে আলোচিত ‘চিকেন নাগেটস’ মামলাটিও ছিল, যা ব্যাপকভাবে এমনভাবে প্রচার করা হয়েছিল যে, এক শিশুর বিদেশি খাবার অপছন্দের কারণে তার বাবাকে বহিষ্কার করা যায়নি। বাস্তবে রায়টি ওই বিষয়ে নির্ভরশীল ছিল না এবং পরবর্তীতে সেই সিদ্ধান্ত বাতিলও হয়ে যায়।
যুক্তরাজ্যের ইসিএইচআর সদস্যপদ নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক সাম্প্রতিক সময়ে আরও তীব্র হয়েছে, বিশেষ করে সরকার যখন অভিবাসীদের বহিষ্কারের উদ্যোগ নেয়। কনজারভেটিভ পার্টি ও রিফর্ম ইউকে উভয়ই দাবি করছে, এই কনভেনশন সরকারের বহিষ্কার কার্যক্রমে বাধা সৃষ্টি করছে এবং তারা ক্ষমতায় এলে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবে।
এদিকে লেবার সরকার মানবাধিকার আইন পর্যালোচনার উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে বহিষ্কার সংক্রান্ত মামলায় সরকার আইনি সুবিধা পায়। আশ্রয়ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে নির্যাতন নিষিদ্ধকারী অনুচ্ছেদ ৩ এবং পারিবারিক জীবনের অধিকার সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ ৮-এ পরিবর্তনের পরিকল্পনাও আলোচনায় রয়েছে।
স্টিফেনসনের মতে, ইসিএইচআর যুক্তরাজ্যের হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তরীণ আইনের অংশ হওয়ায় এটি থেকে সরে গেলে শুধু অভিবাসীদের নয়, সাধারণ নাগরিকদের অধিকারও দুর্বল হয়ে পড়বে। তিনি বলেন, এই কনভেনশন এমন সুরক্ষা দেয় যা সবাই কোনো না কোনো সময়ে প্রয়োজন অনুভব করতে পারেন।
উদাহরণ হিসেবে তিনি সিরিয়াল ধর্ষক জন ওয়ারবয়েজ মামলার কথা তুলে ধরেন, যেখানে পুলিশের গুরুতর তদন্ত ব্যর্থতার জন্য সুপ্রিম কোর্ট তাদের দায়ী করার সুযোগ দিয়েছিল। পাশাপাশি একটি মামলায় এক বৃদ্ধ দম্পতিকে আলাদা করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত মানবাধিকার আইনের মাধ্যমে চ্যালেঞ্জ করা সম্ভব হয়েছিল বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
স্টিফেনসনের ভাষায়, এসব মামলা প্রমাণ করে যে ইসিএইচআর কেবল আইনি তর্কের বিষয় নয়, বরং বাস্তব জীবনে ন্যায়বিচার ও মানবিক সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেয়। তাই এই কনভেনশন থেকে বেরিয়ে যাওয়া এমন অধিকারগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, যেগুলোর ওপর যুক্তরাজ্যের প্রতিটি নাগরিক নির্ভর করে।
এই মাসের শুরুতে ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশন তদারককারী সংস্থার প্রধান জানান, সদস্য রাষ্ট্রগুলো অভিবাসন সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আইনি কাঠামোর মধ্যেই সংস্কার নিয়ে একমত হয়েছে, যা সম্মিলিতভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে

