ইতিহাসের পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়াতে খুব ইচ্ছে করে যা অনেক সময় তৃপ্তি দেয়। প্রত্যেক ব্যক্তির ইতিহাসের অনুভূতি থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ইতিহাস আমাদের চারপাশের ঘটনার প্রতি আমাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক মনোভাবকে সংজ্ঞায়িত করে। আমরা সকলেই ইতিহাসের অনেক ঘটনা ঘটার সময় উপস্থিত ছিলাম না। কারণ বিভিন্ন সময় স্কেলে একেকটা ঘটনার সৃষ্টি হয়, যখন অনেক মানুষ সেইসময়ে উপস্থিত থাকতে পারে না। তাই পরবর্তীতে ঘটে যাওয়া ঘটনাবহুল ইতিহাস আমাদের অনুভূতিকে নাড়া দেয়।
ইতিহাস নিয়ে সকলেই তর্ক করতে পারে। প্রত্যেকে নিজস্ব একেকটা যুক্তি দাঁড়া করাতে পারে। স্থান এবং সময় সমান্তরালভাবে চলে। তাই যুক্তিতর্কের উর্ধ্বে উঠে ইতিহাস পর্যালোচনা করা উচিত।
বাংলাদেশেরও এমন ইতিহাস রয়েছে যেখানে নানা ধরনের ঘটনা ঘটেছে প্রতিনিয়ত। মানুষ নিজেদের প্রয়োজনে ইতিহাসের পাতা হতে একটি স্বল্পমেয়াদী দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে থাকে।
গত পঞ্চাশ বছরের বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে ১৯৭১ সাল পরবর্তী একটি সময় চোখে ভেসে উঠে। ১৯৭৪ সালে ফিরে গেলে এমন কয়েকটি ঘটনার প্রতিফলন দেখতে পাই যা ঐতিহাসিকভাবে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। তখন আমার বয়স বিশের কোঠায়, অনেক জিনিস মনে পড়ে যা এখন ইতিহাসের পাতা হতে টেনে টেনে মিলিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে।
১৯৭৪ সালে ভূ -রাজনীতির মোড়গুলি এমন আকার দিয়েছিল যা অনেকেই ভাবেনি এরকম ঘটতে পারে। ভারত তার পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করেছে। ইন্দিরা গান্ধী পুরো বিশ্বে নিজের একটি অবস্থান তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
বাংলাদেশ, ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষের জোয়ারের সাথে লড়াই করে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সরকার নিজেদের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য লড়াই করে যাচ্ছিল প্রতিনিয়ত। তখন বাংলাদেশ জাতিসংঘে নতুন সদস্য-রাষ্ট্র হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে মাত্র। বঙ্গবন্ধু সরকার হতে তাজউদ্দিন আহমেদ অকস্মাৎ বিদায় নিলেন যা আমাদের দুঃখ দিয়েছিল।
১৯৭৪ সালটি ছিল বিশ্ব রাজনীতির জন্য অনেক ঘটনাবহুল। হোয়াইট হাউস থেকে বিদায় নিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সন। নিক্সনের প্রস্থান বিশ্ব রাজনীতিতে যে প্রয়োজনীয় পাঠ দেয় তা হলো ক্ষমতার দুর্নীতি গণতন্ত্রের কাঠামোকে হুমকির মুখে ফেলে। ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি নিক্সনকে ধ্বংস করে দিয়েছিল। কিন্তু নিক্সনের পদত্যাগ আমেরিকার গণতান্ত্রিক রাজনীতির মহিমাকে পূণরায় পুনরুদ্ধার করে।
১৯৭৪ সালে ইথিওপীয় সেনাবাহিনীর বিদ্রোহী কর্মকর্তারা সম্রাট হেইল সেলাসিকেও পদচ্যুত করে। তবে ব্রিটেনে গণতন্ত্র চলছিল নিরবিচ্ছিন্নভাবে। হ্যারল্ড উইলসন লেবার পার্টিকে ক্ষমতায় ফেরান এই বছরে যদিও ৪ বছর পর এডওয়ার্ড হিথের কনজারভেটিভ দলের কাছে নির্বাচনে হেরে যান। তবে সেটা ছিল সাধারণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। তিন বছর ধরে পাকিস্তান তাদের দেশের অভ্যন্তরে নানা সমালোচনামূলক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল। পাকিস্তান আহমদিয়াদের ইসলামী পরিচয় প্রদানে নিষেধাজ্ঞা ডিক্রি দেয় এই সময়ে।
দক্ষিণ এশিয়ার জন্য ১৯৭৪ সাল নানা ঘটনার জন্ম দেয়। বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে তাদের সম্পর্ক ভবিষ্যতের স্বার্থে পুনঃস্থাপন করে। শেখ মুজিব ও ভুট্টো একে অন্যের সাথে সম্পর্ক তৈরিতে এগিয়ে আসেন।
২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪ এ পাকিস্তানের লাহোরে শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত বাজিয়ে, তোপধ্বনি এবং গার্ড অফ অনার দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো। এর আগের দিনই বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছিল পাকিস্তান। সে বছর জুন মাসে মি. ভুট্টোও এসেছিলেন বাংলাদেশে।
ঢাকায় মি. ভুট্টো বলেছিলেন, “যা হয়েছে তা নিয়ে অন্তর থেকে অনুতপ্ত হতে বা তওবা করতে দেরি হয়ে যায়নি। পাকিস্তানের মানুষ আপনাদের সিদ্ধান্তকে শ্রদ্ধা জানায়। তারা এবং পাকিস্তানের সরকার বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে স্বীকার করে এবং শ্রদ্ধা জানায়।”
১৯৭৪ এর এপ্রিলের বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যকার ত্রিপাক্ষিক চুক্তির বিবরণেও রয়েছে যে জুলফিকার আলী ভুট্টো বাংলাদেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করেছেন যেন তারা পাকিস্তানকে ক্ষমা করে দেন এবং অতীতের কথা ভুলে গিয়ে সামনে এগিয়ে যান।
শেখ মুজিবুর রহমানের তরফ থেকেও অতীত ভুলে নতুন সূচনা করার এবং “ক্ষমার নিদর্শন হিসেবে বিচার না চালানোর” সিদ্ধান্তের কথার উল্লেখ রয়েছে।
তবে মনে প্রশ্ন আসে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য মুজিব সরকার কি জোর দিয়েছিলেন?
নাকি ভুট্টোর সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তুলতে এই বিষয় বেমালুম চেপে যাওয়া হয়েছিল।
অর্ধ শতাব্দী আগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা আমাদের মনে রাখা দরকার। কারণ ইতিহাস সকলের জন্য সঠিক তথ্য তুলে ধরতে পারে যদি তা সত্যবচনের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। ১৯৭৪ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শীতল যুদ্ধ নিম্ন স্তরে ছিল।
যদিও পৃথিবী কখনও প্রশান্ত জায়গায় পরিনত হবার সম্ভাবনা নেই তবুও আমাদের বাস্তববাদী হওয়া উচিত। রাজনীতি কখনও প্রশান্তির সম্পর্কে নয়, বাস্তববাদ সম্পর্কে ভারসাম্যের অবস্থান সৃষ্টি করে। ১৯৭৪ সালের হিসাবে, বাস্তববাদ বিশ্বকে আপেক্ষিক অর্থে স্থিতিশীলতায় রাখে।
সাংবাদিক ও লেখকঃ সৈয়দ বদরুল আহসান
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪