ইসরায়েলে হামলার পর এ নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে চীন। ইরানের পক্ষে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করেছে দেশটি। এরমধ্যে চীন থেকে ইরানে রহস্যময় বিমান পাঠানো হয়েছে।
বুধবার (১৭ জুন) সংবাদমাধ্যম দ্য টেলিগ্রাফের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইরানে ইসরায়েলের হামলার ঠিক একদিন পর চীন থেকে একটি রহস্যজনক কার্গো বিমান ইরানের দিকে রওনা হয়েছে। এরপর আরও একটি বিমান চীনের উপকূলীয় শহর থেকে ছেড়ে গেছে। এছাড়া সোমবার সাংহাই থেকে তৃতীয় আরও একটি বিমান ইরানে গেছে। এ নিয়ে তিন দিনে ৩টি বোয়িং ৭৪৭ বিমান ইরানে পাঠানো হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি বিমানই চীনের উত্তরাঞ্চল হয়ে কাজাখস্তানে প্রবেশ করে, সেখান থেকে দক্ষিণে উজবেকিস্তান ও তুর্কমেনিস্তানের আকাশসীমা পাড়ি দেয়। কিন্তু ইরান সীমান্তের কাছে আসতেই সেগুলোর অবস্থান রাডার থেকে হারিয়ে যায়।
আরও চাঞ্চল্যকর বিষয় হলো, উড়ানপথ অনুযায়ী এসব বিমানের গন্তব্য ছিল লুক্সেমবার্গ, তবে বাস্তবে সেগুলোর কোনো বিমানই ইউরোপের আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি।
এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে—ইরান-ইসরায়েল চলমান সংঘাতের মধ্যে চীন থেকে কী ধরনের সামগ্রী ইরানের দিকে পাঠানো হলো তা নিয়ে।
বিমানগুলো ছিল বোয়িং ৭৪৭ ফ্রেইটার, যা সাধারণত সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্র পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত হয় এবং বিভিন্ন সরকারী চুক্তির আওতায় পরিচালিত হয়। এমন তথ্য জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা।
‘চীন ইরানকে সহযোগিতা করতে পারে—এই প্রত্যাশায় এই কার্গো বিমানের গতিপথ অনেক আগ্রহের জন্ম দিয়েছে,’ বলেন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার সঙ্গে চীনের সম্পর্ক নিয়ে গবেষণা করা ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটারের প্রভাষক আন্দ্রেয়া গিসেলি।
চীন ও ইরান কৌশলগত অংশীদার—যাদের মধ্যে প্রধান মিল হলো মার্কিন নেতৃত্বাধীন বিশ্ব ব্যবস্থার বিরোধিতা এবং বহুমেরু কূটনীতির পক্ষে অবস্থান।
ইরান চীনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি সরবরাহকারী, প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ ব্যারেল তেল পাঠায়। ফলে ইরানের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চীনের অর্থনৈতিক ও জ্বালানি স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
‘ইরানের বর্তমান সরকার পতন হলে মধ্যপ্রাচ্যে মারাত্মক অস্থিরতা তৈরি হবে, যা চীনের স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে,’ বলেন গিসেলি।
চীন অতীতেও সমালোচনার মুখেও ইরানে অস্ত্র ও সামরিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির জন্য ব্যবহৃত হাজার হাজার টন উপাদান, যা পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণে ব্যবহৃত হতে পারে।
যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে চীন সতর্কতার সঙ্গে এগোচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইরান-ইসরায়েল সংঘাতে সরাসরি জড়িত হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা নষ্ট হয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
‘এই মুহূর্তে চীনা সামরিক সরঞ্জাম প্রকাশ্যে পাঠানো হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা বাড়বে, যা এমনিতেই সাম্প্রতিক বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে টালমাটাল,” বলেন গিসেলি। “এর ফলে এমন অনেকে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিতেও পারে, যাতে চীনকে চাপে রাখা যায়।’
ইসরায়েলের ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজ-এর চীন ও মধ্যপ্রাচ্য বিশেষজ্ঞ তুভিয়া গেরিং বলেন, ‘চীন সরাসরি প্রতিরক্ষা সামগ্রী পাঠাবে—এই সম্ভাবনা এখনো কম, তবে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। বিষয়টি ঘনিষ্ঠভাবে নজরে রাখা উচিত।’
ফ্লাইট ডেটা অনুযায়ী, কয়েকটি ফ্লাইট পরবর্তীতে তুর্কমেনিস্তান-ইরান সীমান্ত এলাকার কাছ থেকে আবার লুক্সেমবার্গের দিকে উড়েছে। কিন্তু কী বহন করছিল সেসব বিমান, তা স্পষ্ট নয়।
কার্গোলোক্স, লুক্সেমবার্গ-ভিত্তিক বিমান সংস্থা যেগুলো ফ্লাইট পরিচালনা করেছে, জানিয়েছে তাদের বিমান ইরানের আকাশসীমা ব্যবহার করেনি। তবে কী বহন করছিল সেই প্রশ্নের উত্তর সংস্থাটি দেয়নি।
কার্গো মেনিফেস্ট বা মাল তালিকা জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। বিপজ্জনক বা বিশেষ সামগ্রী থাকলে তা বিমান সংস্থা ও হ্যান্ডলিং এজেন্টদের জানাতে হয়, তবে সেসব তথ্য ভুল বা বিভ্রান্তিকরও হতে পারে।
চীনের আগে অস্ত্রকে বেসামরিক পণ্যের আড়ালে পাঠানোর নজির আছে—একবার ড্রোনের যন্ত্রাংশকে উইন্ড টারবাইনের যন্ত্র হিসেবে লেবেল দিয়ে পাঠানো হয়েছিল।
দ্য টেলিগ্রাফ-এর একটি তদন্তে দেখা গেছে, চীন এক বিলিয়ন ডলারের ড্রোন লিবিয়ায় পাঠানোর চেষ্টা করেছিল, যেখানে যুক্তরাজ্য, তিউনিশিয়া ও মিসরের শেল কোম্পানিগুলোর মাধ্যমে তেল বিনিময়ে ড্রোন পাঠানো হয়েছিল।
সূত্রঃ দ্য টেলিগ্রাফ
এম.কে
২০ জুন ২০২৫