7.8 C
London
November 26, 2024
TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

ঋণের ধোঁকা দিয়ে সারা দেশ থেকে ঢাকায় লোক জমায়েতের চেষ্টা

বিনা সুদে এক লাখ থেকে কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ দেয়া হবে এমন প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন জেলা থেকে সাধারণ মানুষকে রাজধানীতে এনে গণসমাবেশ করতে চেয়েছিল একটি মহল। গতকাল সোমবার সকাল ১০টা থেকে শাহবাগে তাদের বিশাল গণজমায়েতের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু বিষয়টি শিক্ষার্থীদের নজরে এলে তাদের পরিকল্পনা পণ্ড হয়ে যায়।

ঢাকা ও কয়েক জেলায় বাসে আসা সাধারণ লোকজনকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। কোনো কোনো স্থানে এসব গাড়ির তদারকিতে থাকা কিছু ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ঋণের প্রলোভনে জমায়েতের চেষ্টা করা ‘অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ’র আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তাফা আমীনকে গত সন্ধ্যায় আটক করেছে রাজধানীর শাহবাগ থানা পুলিশ।

এ দিকে ভোরে ঢাকায় গণজমায়েতের উদ্দেশ্যে আসতে চাওয়া আটটি বাস ও ১০টি মাইক্রোবাস আটক করেছে লক্ষ্মীপুরের ছাত্র-জনতা। নারায়ণগঞ্জে ৪ বাসসহ আটক হন ২০০ জন। টাঙ্গাইলের দুই উপজেলায় গাড়িসহ ৭৩ জনকে আটক করা হয়েছে। সন্দেহ হওয়ায় কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে যাত্রীবাহী ৮টি বাস আটক করে শিক্ষার্থী ও গ্রামবাসী। এ ছাড়া গতকাল সকালে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বাসের যাত্রীদের আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন শিক্ষার্থীরা।

এ দিকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে গণজমায়েত করে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার সন্দেহে চারজনকে আটক করেছে পুলিশ।

গতকাল বিষয়টি জানাজানি হতেই দেশজুড়ে শুরু হয় আলোচনা। জমায়েতের আগের রাতে ঢাকায় যারা এসেছিল তারা আসলে কারা? কে সাধারণ মানুষকে বাসভর্তি করে ঢাকায় নিয়ে এলো? এটা নিতান্তই কোনো গণজমায়েত ছিল নাকি আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সহায়তায় দেশকে অস্থিতিশীল করার কোনো ষড়যন্ত্র ছিল? মানুষের মাঝে ঘুরপাক খেতে থাকে এমন নানা প্রশ্ন।

বিভিন্ন জেলা থেকে আসা লোকজন এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ‘অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে সাধারণ মানুষকে শাহবাগে জমায়েতের উদ্দেশ্যে আনা হয়। প্ল্যাটফর্মটির মূল স্লোগান ‘লুণ্ঠিত অর্থ উদ্ধার করব, বিনা সুদে পুঁজি নেব’।

জানা গেছে, ঢাকার বিভিন্ন বস্তি ও আশপাশের এলাকা থেকে সমাবেশে লোক জড়ো করার জন্য কয়েক দিন ধরে নানা কর্মসূচি পালন করে আয়োজক সংগঠনের নেতারা। এ ছাড়া গত ২২ নভেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতিবিরোধী বিশেষ আইন প্রণয়নের দাবিতে ২৫ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সংহতি সমাবেশের ঘোষণা দেয় সংগঠনটি।

তবে সংবাদ সম্মেলনে দুর্নীতিবিরোধী বিশেষ আইন প্রণয়নের দাবিতে সমাবেশের কথা বললেও তারা সারা দেশ থেকে নিরীহ মানুষদের বিনা সুদে ঋণ দেয়ার কথা বলে ঢাকায় নিয়ে আসে। তাই সমাবেশের মূল উদ্দেশ্য কী ছিল তা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।

জানা যায়, সমাবেশে যোগ দেয়ার লক্ষ্যে গত রোববার রাত ১২টার পর বিভিন্ন জেলা থেকে বাস ও মাইক্রোবাস ছাড়তে শুরু করে। কাছের জেলাগুলো থেকে ভোর ৪টার দিকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও শাহবাগের দিকে বাসগুলো থামতে শুরু করে। দূরবর্তী জেলাগুলো থেকে আসা বাসগুলো সকাল ৮টার দিকে এসে পৌঁছায়। ভোর থেকে দেশের ১০-১২টি জেলা থেকে বাস ও মাইক্রোবাসে করে কয়েক হাজার লোককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-শাহবাগ এলাকায় জড়ো করা হয়।

এ দিকে সন্দেহ হওয়ায় ঢাবি ক্যাম্পাসে দিনাজপুর, গাইবান্ধা, যশোর, ঝিনাইদহ, কিশোরগঞ্জ, চুয়াডাঙ্গা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ থেকে আসা অনেক বাস ও মাইক্রোবাস আটক করা হয়। এসব বাস ও মাইক্রোবাসের যাত্রীরা জানান তাদের বিনা সুদে ঋণ দেয়া হবে বলে আনা হয়েছে। সমাবেশের কথা তারা জানতেন না।

‘অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্মের ব্যানারে সাধারণ মানুষকে শাহবাগে জমায়েতের উদ্দেশ্যে ঢাকায় আনতে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দি, চাঁদপুর জেলার কচুয়া উপজেলা ডুমিরিয়ার রুনা ও মানিকগঞ্জের দবির নামে তিনজন ভূমিকা রাখেন বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানতে পেরেছেন শিক্ষার্থীরা। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা প্রতিটি বাসে একজন বা দু’জন সব কিছু পরিচালনা করেন বলেও তারা জানতে পারেন। প্ল্যাটফর্মের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তাফা আমীনের ছবি সংবলিত ব্যানার ও লিফলেট ছিল অনেকের হাতে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সোমবার ভোর ৪টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বাস-মাইক্রোবাসে তল্লাশি চালান এবং তাদের আসার কারণ জানতে চান। তখন তারা বিনা সুদে ঋণ পাওয়ার আশায় এখানে এসেছেন বলে জানান। পরে প্রক্টরিয়াল বডি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মাধ্যমে তাদের ফেরত পাঠানো হয়। জমায়েতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৫-২০ জনকে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছেন শিক্ষার্থীরা।

তাছাড়া চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে শাহবাগ থানা পুলিশ। তারা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়।
মানিকগঞ্জ থেকে বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর শাহবাগে আসে ছয়টি বাস। বাসের যাত্রীদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, কাগজপত্র নিয়ে জরিনা কলেজের সামনে থেকে আমাদের বাসে উঠতে বলা হয়। টাকা দেয়া হবে বলে আমাদের ঢাকায় নিয়ে আসেন দবির নামে এক ব্যক্তি। দবির সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা কেউ চেনেন না বলে জানান। চাঁদপুরের কচুয়ার ডুমুরিয়া থেকে কয়েকটি বাসে করে আনা হয় নারীদের। জানতে চাইলে তারা জানান, স্থানীয় রুনা নামে এক নারী তাদের ১ লাখ টাকা দেবে বলে ঢাকায় নিয়ে এসেছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন জেলা বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় ‘অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্মের নামে সদস্য আহ্বান, ঋণ প্রদানে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়। মাত্র ৫ টাকায় সদস্য ফরম সংগ্রহ ও ঢাকায় সমাবেশে অংশ নিয়ে মাসে মাত্র ৩ হাজার টাকা কিস্তি দিলেই মিলবে ১ লাখ থেকে কোটি টাকা ঋণ- এমন প্রলোভন দেখানো হয় প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে। পরে তাদের কাছ থেকে যাতায়াত বাবদ ‘টোকেন মানি’ ৩০০-৪০০ টাকা করে সংগ্রহ করে চক্রটির সদস্যরা। শুধু তাই নয়, সুনামগঞ্জে সুইস ব্যাংক থেকে সুদ ছাড়া ঋণ দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে এনআইডি কার্ড জমা নেয়া হয়। কিশোরগঞ্জের ভৈরবের ঋষিপট্টি, কুড়িগ্রামসহ বিভিন্ন জেলায় লাখ টাকা ঋণ দেয়ার নামে সদস্য সংগ্রহ করা হয়। সদস্য হতে প্রত্যেকের কাছ থেকে নেয়া হয় মাত্র ৫ টাকা।

গত ১২ নভেম্বর শাহবাগে গণজমায়েতের লক্ষ্যে বিনা সুদে ঋণ দেয়া হবে প্রচার করে প্রতারণা ও সদস্য সংগ্রহের অভিযোগে নওগাঁ থেকে চারজনকে আটক করে পুলিশ। ১৬ নভেম্বর গাজীপুর থেকে আরো চারজন, চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ থেকে ২ জন, টাঙ্গাইলের ভুয়াপুর থেকে দুই নারীসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়। গতকাল সোমবার মানিকগঞ্জ থেকে ৫ জন ও টাঙ্গাইল থেকে ১৩ জনকে আটক করা হয়েছে।

এদিকে, আটকদের কাছে কিছু প্রচারপত্র পাওয়া গেছে। তাদের কাছ থেকে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ও থানার কিছু ক্লিয়ারেন্স, টাকার জন্য আবেদনকারীদের তালিকাসহ বিভিন্ন ধরনের কাগজ জব্দ করা হয়েছে। তবে সেগুলো নকল দাবি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একটি চক্র দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে সাধারণ মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে ঢাকায় এনেছে।

বাসে তল্লাশি ও জিজ্ঞাসাবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল মেহরাজ মিথুন বলেন, প্রতিটি বাসেই একজন করে নেতা গোছের পুরুষ বা নারী ছিলেন, যারা সাধারণ আমজনতাকে ঢাকায় এনেছেন। পরে বাসে থাকা জনসাধারণের সঙ্গে কথা বলে তাদের পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছি। আমরা ৮-১০টি জেলার বাস পেয়েছি, যার অধিকাংশই উত্তরাঞ্চলের। দেশকে অস্থিতিশীল করতে এমন পরিকল্পনা করা হয়েছিল কিন্তু আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সেটা প্রতিহত করেছি।

পুলিশ সূত্র জানিয়েছে, একটি চক্র রাতের আঁধারে বিভিন্ন জেলা থেকে রাজধানীতে জনসমাগম করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করেছিল। শাহবাগে জমায়েত সম্ভব না হলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় ঘেরাওয়ের পরিকল্পনাও ছিল তাদের। সে লক্ষ্যেই তারা অন্তত এক মাস ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকায় প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে সদস্য সংগ্রহ করে ঢাকায় এনেছিল।

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর সংবাদমাধ্যমকে বলেন, আটকদের আমরা জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে যাচ্ছি। তাদের জড়ো হওয়ার উদ্দেশ্য কী, কেন তারা মানুষকে প্রলোভন দেখিয়ে জড়ো করেছিল তা জিজ্ঞাসাবাদের পরে জানা যাবে।

এম.কে
২৬ নভেম্বর ২০২৪

আরো পড়ুন

প্রধান উপদেষ্টা সুস্থ আছেন, গুজব না ছড়ানোর অনুরোধ

পথ খোলা মাত্র তিনটি; কী করবেন শেখ হাসিনা?

বৃষ্টিতে মন্ত্রীর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম যেন চাকুরির জন্য গিয়েছিঃ বানিজ্য উপদেষ্টা