ফিলিস্তিন সংহতির প্রভাব, নৈতিক ভোট এবং নজিরবিহীন নাগরিক সক্রিয়তার মাধ্যমে মুসলিম রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।
কানাডার ২০২৫ সালের ফেডারেল নির্বাচন মুসলিম প্রতিনিধিত্বে এক ঐতিহাসিক মাইলফলক ছুঁয়েছে। এবার হাউস অব কমন্সে নির্বাচিত হয়েছেন ১৩ জন মুসলিম সংসদ সদস্য, যা আগের সংখ্যার (১১ জন) চেয়ে বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নজিরবিহীন বৃদ্ধি কানাডীয় মুসলমানদের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক প্রভাবের প্রতিফলন, বিশেষত বৃহত্তর টরন্টো এলাকার (GTA) মতো শহরাঞ্চলে, যেখানে মুসলিম জনসংখ্যা এখন ১২–১৪ শতাংশ।
যদিও ১৩ জন মুসলিম প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন, তবে আরো ২১ জন খুব অল্প ব্যবধানে দ্বিতীয় হয়েছেন।
নির্বাচনী প্রচার প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত হয়েছে বৈশ্বিক ঘটনাবলির দ্বারা — যার মধ্যে প্রধান হলো ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের যুদ্ধ। চলমান মানবিক সংকট। যার ফলে মসজিদ, কমিউনিটি হল এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ভোটারদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে।
ফিলিস্তিন ইস্যুটি অনেকের কাছে নৈতিক একটি মানদণ্ড হয়ে দাঁড়ায়। প্রার্থীদের গাজা নিয়ে অবস্থান, যুদ্ধবিরতির দাবি ও মানবিক সহায়তা নিয়ে মতামত ছিল গভীর পর্যবেক্ষণের আওতায়।
জবাবে, সমগ্র কানাডাজুড়ে ১০০-র বেশি মুসলিম সংগঠন একত্রিত হয়ে একটি ন্যায়ভিত্তিক, মর্যাদাপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত ভোট নীতির আহ্বান জানায়।
কানাডিয়ান মুসলিম পাবলিক এফেয়ার্স কাউন্সিল (CMPAC) তাদের MuslimsVote.ca ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ৪৫ জন প্রার্থীকে সমর্থন দেয়, যারা মানবাধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা এবং বিদেশ নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।
একইসঙ্গে, ৩০০-র বেশি প্রার্থী “Vote Palestine” প্ল্যাটফর্মে স্বাক্ষর করেন, যারা কানাডার ফিলিস্তিন সংক্রান্ত অবস্থান আরও জোরালো করতে চেয়েছেন। নির্বাচিত অনেক এমপি এই উদ্যোগকে সমর্থন করেছিলেন, যার ফলে তৃণমূল পর্যায়ের সচেতনতা নির্বাচনী সফলতায় রূপ নেয়।
নির্বাচনের ফলে পার্লামেন্ট এখন আরও বৈচিত্র্যময় ও প্রতিনিধিত্বমূলক, বিশেষত তাদের জন্য যারা এতদিন জাতীয় রাজনীতিতে প্রান্তিক পর্যায়ে ছিলেন।
নতুন নির্বাচিত ১৩ জন মুসলিম এমপি লেবানন, পাকিস্তান, ইরান, সোমালিয়া, তুর্কি ইত্যাদি পটভূমি থেকে উঠে আসা —যা কানাডার বহুত্ববাদকে প্রতিফলিত করে।
নির্বাচনের ফলাফলঃ
প্রধানমন্ত্রী মার্ক কারনি নেতৃত্বাধীন লিবারেল পার্টি ১৬৮টি আসন পেয়ে সংখ্যালঘু সরকার গঠন করে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার ক্ষেত্রে মাত্র ৪টি আসন কম।
কনজারভেটিভ পার্টি ১৪৪টি আসন পায়, যদিও পিয়েরে পলিয়েভ্রে নিজেই অন্টারিওর কার্লটন আসনে পরাজিত হন। ব্লক কিউবেকোয়া ২৩টি,
এনডিপি মাত্র ৫টি, গ্রিন পার্টি ১টি আসন পায়।
নতুন সংযোজনঃ পার্লামেন্টে এখন ৩৪৩টি আসন রয়েছে (আগে ছিল ৩৩৮), ২০২১ সালের আদমশুমারির ভিত্তিতে পুনর্বণ্টনের কারণে শহরাঞ্চলের অভিবাসী ও মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে।
২০২৫ সালের নির্বাচনে নির্বাচিত ১৩ জন মুসলিম এমপি হলেন,
আব্দেলহাক সারি (লিবারেল – বোরাসা, কিউবেক) – নিরাপত্তা ও এতিম কল্যাণে কাজ করেন। জয়ী হন ৫৮.৫% ভোটে।
সামীর জুবেরি (লিবারেল – পিয়ারেফঁ—ডলার্ড, কিউবেক) – মানবাধিকার কর্মী, ২০১৯ থেকে এমপি। পুনর্নির্বাচিত ৬০% ভোটে।
শফকত আলী (লিবারেল – ব্র্যাম্পটন—চিঙ্গাকুসি পার্ক, অন্টারিও) – ব্যবসায়ী ও স্বেচ্ছাসেবক। জয়ী ৪৮.৭% ভোটে।
আসলাম রানা (লিবারেল – হ্যামিলটন সেন্টার, অন্টারিও) – সিভিল ইঞ্জিনিয়ার, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামোতে মনোযোগী।
ফারেস আল সউদ (লিবারেল – মিসিসাগা সেন্টার, অন্টারিও) – নতুন মুখ, জয়ী ৫৩.৭% ভোটে।
ইকরা খালিদ (লিবারেল – মিসিসাগা—এরিন মিলস, অন্টারিও) – ইসলামোফোবিয়া ও রোহিঙ্গা গণহত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার।
সিমা আছান (লিবারেল – ওকভিল ওয়েস্ট, অন্টারিও) – প্রথম তুর্কি-কানাডিয়ান এমপি।
ইয়াসির নাকভি (লিবারেল – অটোয়া সেন্টার, অন্টারিও) – সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল, ন্যায় সংস্কারে আগ্রহী।
সালমা জাহিদ (লিবারেল – স্কারবরো সেন্টার—ডন ভ্যালি ইস্ট, অন্টারিও) – মানবাধিকার প্রশ্নে স্পষ্টভাষী।
করিম বারদিসি (লিবারেল – তাইয়াইকোন—পার্কডেল—হাই পার্ক, অন্টারিও)
আলি এহসাসি (লিবারেল – উইলোডেল, অন্টারিও) – ইরানি বংশোদ্ভূত, আন্তর্জাতিক বিচার ও মানবাধিকার ইস্যুতে কাজ করেন।
আহমেদ হুসেন (লিবারেল – ইয়র্ক সাউথ—ওয়েস্টন—এটোবিকোক, অন্টারিও) – সাবেক অভিবাসন মন্ত্রী।
তালিব নুর মোহাম্মদ (লিবারেল – ভ্যাঙ্কুভার গ্র্যানভিল, ব্রিটিশ কলম্বিয়া) – হার্ভার্ড শিক্ষিত, ডিজিটাল নীতিতে অভিজ্ঞ।
সূত্রঃ মুসলিম নেটওয়ার্ক টিভি
এম.কে
০২ মে ২০২৫