মধ্যপ্রাচ্য সংকটে কানাডার কণ্ঠস্বর এবার ভিন্ন সুরে শোনা গেল। ইসরায়েলের সামরিক অভিযান ও ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান নিপীড়নের প্রতিবাদে যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্সের সঙ্গে মিলে এক জোরালো বিবৃতি দিয়েছে দেশটি। বহুদিন ধরে সংযত ভাষায় প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসা কানাডার কূটনীতি যেন এবার মানবিক বিপর্যয়ের মুখে নিজেদের পুরোনো অবস্থান পুনর্মূল্যায়ন করেছে।
যৌথ বিবৃতিতে গাজার পরিস্থিতিকে ‘সহনক্ষমতার বাইরে’ বলে অভিহিত করা হয়েছে এবং ইসরায়েলের দেওয়া মানবিক সহায়তাকে ‘অত্যন্ত অপ্রতুল’ বলে সরাসরি সমালোচনা করা হয়েছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের পর ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া নিয়ে বলা হয়েছে, সেটি ছিল ‘অতিরিক্ত সহিংস’ এবং ‘নির্মম’। গাজায় এখন পর্যন্ত নিহত হয়েছে অন্তত ৫৪ হাজার মানুষ—এমনকি এই সংখ্যাটিও চূড়ান্ত নয় বলে ধারণা দিচ্ছে চিকিৎসা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট।
এই অবস্থায়, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও ফ্রান্স জানিয়ে দিয়েছে, তারা আর নীরব থাকবে না। পশ্চিম তীরে দখলদারদের সহিংসতা ও বসতি সম্প্রসারণের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে তারা নিষেধাজ্ঞাসহ দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।
কানাডার অবস্থান পরিবর্তনের পেছনে বেশ কিছু বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। নতুন প্রধানমন্ত্রী মার্ক কার্নি, যিনি আগে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড ও ব্যাংক অব কানাডার গভর্নর ছিলেন, রাজনীতির বাইরে থেকে আসা একজন কৌশলী নেতা হিসেবে আরও স্পষ্ট ও নীতিনির্ভর বার্তা দিচ্ছেন। বিশেষজ্ঞদের মতে, তার রাজনৈতিক বোঝা কম, ফলে বিতর্কিত ইস্যুতেও তিনি দ্ব্যর্থহীন অবস্থান নিতে পারছেন।
কানাডার প্রভাবশালী আইন বিশেষজ্ঞ মাইকেল লিঙ্ক মন্তব্য করেছেন, “ইসরায়েল ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ে কানাডার কাছ থেকে এমন কঠিন ভাষা শুনিনি বহু বছর ধরে—সম্ভবত কখনোই না।” তার মতে, মানবিক বিপর্যয় এতটাই গভীর হয়েছে যে, এই মুহূর্তে নেতার ভূমিকা গ্রহণ করা জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সম্প্রতি অধিকৃত পশ্চিম তীরে সফররত চার কানাডীয় কূটনীতিকের ওপর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণ কানাডার প্রতিক্রিয়ায় আরেকটি মাত্রা যোগ করেছে। দেশটি এ ঘটনায় কড়া ভাষায় নিন্দা জানিয়ে তদন্ত ও ব্যাখ্যার দাবি জানিয়েছে।
এদিকে, ফরাসি প্রেসিডেন্ট মাখোঁ ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার আগে থেকেই ইসরায়েলের কার্যকলাপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছিলেন। স্টারমার ইতিমধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করেছেন ও দখলদারদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন।
কানাডা অতীতে প্রায়ই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের সঙ্গে সমন্বয় করে প্রতিক্রিয়া জানাত। তবে এবার ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের পাশে দাঁড়িয়ে নিজস্ব নীতিগত অবস্থান তুলে ধরেছে। এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কানাডার সাবেক এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, “এই অবস্থান কানাডার জন্য নতুন ধরণের রাজনৈতিক অভিব্যক্তি—যেখানে তারা আর নিছক অনুসারী নয়।”
বিশ্বের মানবাধিকার সংস্থাগুলো গাজায় চলমান সংঘর্ষকে সরাসরি ‘গণহত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। আন্তর্জাতিক বিচার আদালত বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। এই প্রেক্ষাপটে কানাডার কঠোর বিবৃতি ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র—উভয়ের জন্য একটি কূটনৈতিক বার্তা।
মধ্যপ্রাচ্যে শক্তি ভারসাম্যের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কানাডার এই অবস্থান আন্তর্জাতিক নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পালাবদল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। যদিও দেশটির অভ্যন্তরে ইসরায়েলপন্থী প্রভাবশালী গোষ্ঠী রয়েছে, তবুও রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভারসাম্য বজায় রাখার সক্ষমতা কানাডাকে এ মুহূর্তে একটি নিরপেক্ষ ও নীতিনিষ্ঠ ভূমিকা পালনের সুযোগ করে দিয়েছে।
ডেমোক্রেসি ফর দ্য আরব ওয়ার্ল্ড নাউ (ডিএডব্লিউএন)-এর অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর রায়েদ জারার বলেন, “কানাডার বক্তব্য এখন আর শুধু বিবৃতি নয়, এটি একটি কার্যকর বার্তা—যা বোঝায়, তারা আর চুপ করে বসে থাকবে না।”
সূত্রঃ দ্য ল্যানসেট
এম.কে
২৩ মে ২০২৫