ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে একটি নতুন পাইলট প্রকল্পের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে৷ যেটির আওতায় প্যারিস ও লন্ডনের মধ্যে অভিবাসী বিনিময়ের ব্যবস্থা করা হবে৷ ইউএনএইচসিআর এই উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও অধিকাংশ মানবাধিকার সংস্থা, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং রাজনৈতিক দলগুলো এই পরিকল্পনার কড়া সমালোচনা করেছেন।
নতুন চুক্তি অনুযায়ী যুক্তরাজ্যে ছোট নৌকায় করে পৌঁছানো একজন অভিবাসীকে ফ্রান্সে ফেরত পাঠানো হবে এবং এর বিনিময়ে ফ্রান্সে থাকা একজন অভিবাসীকে গ্রহণ করবে যুক্তরাজ্য৷
তবে এক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যে যেতে চাওয়া ব্যক্তিকে অনলাইনে ব্রিটেনে আশ্রয় চেয়ে আবেদন করতে হবে এবং সেখানে যাওয়ার যথার্থ কারণ দেখাতে হবে৷ এই পরিকল্পনাটি এখনও ইউরোপীয় কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে৷
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) এক বিবৃতিতে বলেছে,
এটি সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা হলে এই উদ্যোগ বিপজ্জনক যাত্রার বিকল্প হিসেবে একটি সমন্বিত ও মানবিক অভিগমনের সুযোগ এনে দিতে পারে। যার ফলে আশ্রয়প্রার্থীদের অধিকারও রক্ষা করা সম্ভব হবে।
তবে এই আশাবাদী বক্তব্যের বাইরে অধিকাংশ এনজিও ও অভিবাসন সংস্থা এই উদ্যোগকে মানবিক মূল্যবোধের পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে।
দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস জানিয়েছে, এই পরিকল্পনা শুধু হাস্যকর নয় বরং অত্যন্ত বিপজ্জনকও। সংস্থাটি দুই দেশের সরকারকে নিরাপদ এবং বৈধ অভিবাসনপথ উন্মুক্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।
অভিবাসীদের সহায়তায় কাজ করা ফরাসি সংগঠন ইতুপিয়া ৫৬ বলেছে, “এই চুক্তিকে আমরা মানবপাচার বলেই মনে করি। ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য অভিবাসীদের বিনিময় নিয়ে যে ধরনের আলোচনা করছে তা একেবারে অমানবিক।”
কালেতে অভিবাসীদের সহায়তাকারী সংগঠন উবেরজ দে মিগ্রঁ-এর সমন্বয়ক ফ্লোর জুদেত বলেন,
আমরা এখানে মানুষকে কার্ডের মতো বিনিময় করতে দেখছি। এরা এমন মানুষ যারা হাজার হাজার কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে শেষ আশ্রয়ের খোঁজে যুক্তরাজ্যে পৌঁছাতে চায়। এই চুক্তি কোনওভাবেই তাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।
শুধু মানবাধিকার সংস্থাই নয়, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক মহলেও এই চুক্তিকে ঘিরে ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। ব্রিটিশ ডানপন্থি দল ‘রিফর্ম ইউকে’-এর নেতা নাইজেল ফারাজ এই পরিকল্পনাকে ‘অসম্মানজনক’ বলে অভিহিত করেছেন।
তিনি বলেছেন, “আমরা যেন আবারও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য হয়ে গেছি এবং একজন অহঙ্কারী ফরাসি প্রেসিডেন্টের সামনে মাথা নত করছি।”
ব্রিটিশ কনজারভেটিভ দলের প্রধান কেমি ব্যাডেনক এই উদ্যোগের কার্যকারিতা নিয়েও সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, “যদি অনুপাত হয় ১৭ জনকে ঢুকতে দিয়ে ১ জনকে ফেরত পাঠানো, তাহলে তা কোনওভাবেই নিরুৎসাহনমূলক নয়।”
ফ্রান্সের উত্তরাঞ্চলীয় শহর কালের মেয়র নাতাশা বুশের ফ্রান্স ইনফো-তে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন,
এই পরিকল্পনায় স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কোনও আলোচনাই করা হয়নি। সীমান্তে অভিবাসী আগমন সামাল দিতে আমরা এমনিতেই হিমশিম খাচ্ছি,। এখন যুক্তরাজ্য থেকে ফেরত পাঠানো অভিবাসীদের দায়ও আমাদের নিতে হবে।
উত্তর ফ্রান্স রিজিওনের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জাভিয়ের বের্ত্রঁ বলেন, “এই চুক্তি ফ্রান্সের জন্য ক্ষতিকর আর যুক্তরাজ্যের জন্য লাভজনক। তারা পছন্দমতো অভিবাসী বেছে নেবে, আর আমরা শুধু বোঝা বহন করবো।”
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার অভিবাসন ইস্যুকে তার সরকারের প্রধান অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করেছেন।
গত নভেম্বরে স্টারমার মানবপাচারকারীদের দমনে ৯০ মিলিয়ন ইউরোর একটি তহবিল গঠন করেন এবং সার্বিয়া, উত্তর ম্যাসেডোনিয়া, কসোভো ও ইরাকের সঙ্গে একাধিক নিরাপত্তা চুক্তি সই করেন।
যার উদ্দেশ্য পাচারকারীদের ধরতে গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় এবং গ্রেফতার কার্যক্রম জোরদার করা।
তবে এসব ব্যবস্থা সত্ত্বেও ইংলিশ চ্যানেলে ছোট নৌকায় অভিবাসী যাত্রা বন্ধ হয়নি। বরং এই পথ ক্রমেই আরও বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
২০২৪ সালেই চ্যানেল পাড়ি দিতে গিয়ে কমপক্ষে ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। যা ২০১৮ সালের পর সর্বোচ্চ। চলতি বছরও অন্তত ১৭ জন মারা গেছেন বলে জানিয়েছে ফরাসি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
সূত্রঃ ইনফোমাইগ্রেন্টস
এম.কে
১৩ জুলাই ২০২৫