বাংলাদেশে নাগরিকদের ওপর গুরুতর দমন-নিপীড়নের বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক পর্যালোচনায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। গত ১৩ নভেম্বর ইউনিভার্সাল পিরিওডিক রিভিউ (ইউপিআর) বা সর্বজনীন পুনর্বীক্ষণ পদ্ধতির ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশের ইউপিআরের খসড়া গৃহীত হয়। সেখানে বাংলাদেশকে শান্তিপূর্ণ, স্বচ্ছ, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ মানবাধিকার বিষয়ক ৩০১টি সুপারিশ করেছে বিশ্বের ১১০টি দেশ।
আজ বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সেখানে বলা হয়, মানবাধিকার সম্পর্কিত এ উদ্বেগকে বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা উচিত বলে জানায় রাষ্ট্রগুলো।
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের আগে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর চলমান দমন-পীড়নের মধ্যে এ পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে জানায় এইচআরডব্লিউ। জেনেভায় এ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।
জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রকে প্রতি সাড়ে চার বছরে তাদের মানবাধিকার রেকর্ডগুলো ইউএন হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের ইউপিআর অনুসারে পর্যালোচনা করতে হয়। বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়, দেশটির কর্তৃপক্ষের নির্বিচার গ্রেফতার, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং ব্যাপক দমন-পীড়নসহ গুরুতর অপব্যবহার নথিভুক্ত করেছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো।
আরও বলা হয়, স্বাধীনভাবে অভিযোগের তদন্ত ও দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার বদলে বাংলাদেশ সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িতদের পুরস্কৃত করে।
এশিয়া বিষয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, চলমান রাজনৈতিক গণগ্রেফতার, জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সমালোচকদের নির্যাতন বাংলাদেশ সরকারের ‘সবার জন্য মানবাধিকার রক্ষার’ প্রতিশ্রুতিকে অর্থহীন করে তুলেছে।
বলা হয়,”সরকারের মানবাধিকারের প্রতি সত্যিকারের প্রতিশ্রুতি দেখানোর একমাত্র উপায় হলো, আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে বাধ্যবাধকতাগুলো পালন করা। যার মধ্যে রয়েছে নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়ন মোকাবেলা করা এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, সমালোচক ও মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা ব্যক্তিদের হয়রানি ও অপব্যবহার অবিলম্বে বন্ধ করা।
এইচআরডব্লিউ বলছে, গত কয়েক সপ্তাহে ১০ হাজার বিরোধী দলীয় কর্মীসহ রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্বিচারে গণগ্রেফতার করা হয়েছে। তবে সরকার দাবি করেছে যে ‘কোনো রাজনৈতিক বিবেচনা ছাড়াই’ গ্রেফতার করা হয়েছে। নির্বিচারে কোনো আটকের ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে গত ১৪ নভেম্বর জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা বলেন, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতা তীব্রতা বেড়েছে। বিরোধী দলের সিনিয়র নেতাদের গ্রেফতার, হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীকে নির্বিচারে আটক, অত্যধিক বল প্রয়োগের ঘটনায় তারা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। প্রতিবাদ ব্যাহত করার লক্ষ্যে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়া এবং প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে পরিবারের সদস্যদের হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও বেআইনিভাবে আটকের অভিযোগও আনা হয়।
বাংলাদেশী মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের উল্লেখ করে এইচআরডব্লিউ জানায়, ২০০৯ সাল থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ৬০০টিরও বেশি জোরপূর্বক গুমের ঘটনা ঘটেছে। কিছু লোককে পরে ছেড়ে দেয়া হয়। কোনো কোনো ব্যক্তিকে আদালতে হাজির করা। হত্যার শিকার হয়েছেন অনেকে। এখনো প্রায় ১০০ জন নিখোঁজ রয়েছেন। ভুক্তভোগীদের পরিবার জানায়, তারা অভিযোগ দায়েরের সুযোগও পাচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে ‘উপর থেকে আদেশ’ উল্লেখ করে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়।
রিভিউ চলাকালে একাধিক সদস্য রাষ্ট্র বলেছে যে জোরপূর্বক গুম থেকে সবার সুরক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকারের উচিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন অনুমোদন করা।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে, বাংলাদেশ সরকারকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের অফিস থেকে দেয়া সহায়তার প্রস্তাব গ্রহণ করা উচিত। বলপূর্বক গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ উৎঘাটনে তারা ভুক্তভোগী, পরিবার ও সুশীল সমাজের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে।
সর্বশেষ ইউপিআর পর্যালোচনায় ২০১৮ বাংলাদেশ সরকার দাবি করে, তারা গুম সংক্রান্ত ওয়ার্কিং গ্রুপের সভার অনুরোধের অনুকূলভাবে সাড়া দিয়েছে। কিন্তু পাঁচ বছর পর সরকার এখনও জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপকে বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানাতে অস্বীকার করেছে বলে জানানো হয় প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশের ইউপিআরের খসড়া প্রতিবেদন তৈরির দায়িত্ব ছিল কিউবা, পাকিস্তান ও রোমানিয়া। ওই ট্রয়কার পক্ষে বাংলাদেশের ইউপিআরের খসড়া প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন রোমানিয়ার প্রতিনিধি। এ প্রতিবেদন নিয়ে কোনো রাষ্ট্র আপত্তি না করায় তা গৃহীত হয়। বাংলাদেশের ইউপিআরে ১১০টি দেশ আলোচনায় অংশ নিয়ে মতামত দিয়েছে। এ ছাড়া ১২টি দেশ আগাম প্রশ্ন পাঠিয়ে পর্যালোচনায় সহযোগিতা করেছে।
উল্লেখ্য যে, ইউপিআর হলো ১৯৩টি জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রের মানবাধিকার রেকর্ডের পর্যালোচনা। ২০০৮ সালের এপ্রিলে এর প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এম.কে
১৬ নভেম্বর ২০২৩