আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছে। সোমবার দুপুর ২টা ৫০ মিনিটে ট্রাইব্যুনাল-১ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এ ঐতিহাসিক রায় দেন।
রায় ঘোষণার পর ট্রাইব্যুনাল ভবনের সামনে উপস্থিত জনতা উল্লাসে ফেটে পড়েন। তারা স্লোগান দিতে থাকেন— “এ মুহূর্তে খবর এলো, শেখ হাসিনার ফাঁসি হলো”, “দড়ি লাগলে দড়ি নে, শেখ হাসিনার ফাঁসি দে।”
দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, একটিতে আমৃত্যুঃ
ট্রাইব্যুনাল জানায়, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটি প্রমাণিত হয়েছে। এর মধ্যে দুটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড এবং একটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর চানখারপুলে ছয়জনকে গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার অভিযোগে তাকে সর্বোচ্চ দণ্ড দেওয়া হয়।
একই মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে একটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তিনি বর্তমানে পলাতক বলে আদালত জানায়।
রাজসাক্ষী হিসেবে সাক্ষ্য দেওয়ায় আইজিপি মামুনের সাজাঃ
তৃতীয় আসামি সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন রাজসাক্ষী হওয়ায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছেন। গত এক বছর ধরে তিনি কারাগারে রয়েছেন এবং আদালতে বিস্তারিত সাক্ষ্য দিয়ে শেখ হাসিনা ও কামালের ভূমিকা ব্যাখ্যা করেন।
অডিও–ভিডিও, গুলি জব্দসহ বিস্তৃত প্রমাণ উপস্থাপনঃ
রায় পড়ার সময় বিচারপতিরা জুলাই গণঅভ্যুত্থানের দিনগুলোর ঘটনাবলি, হামলা-গুলিবর্ষণ, নিহতদের পরিচয় ও ঘটনার পরিণতি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেন।
উপস্থাপিত হয়—
শেখ হাসিনা ও সরকারি উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিদের ফোনালাপ
ড্রোন ও হেলিকপ্টার থেকে অভিযানে গুলি চালানোর নির্দেশনার রেকর্ড
চানখারপুল, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, সাভার–আশুলিয়া, রংপুরসহ বিভিন্ন স্থানের গুলি বর্ষণের ভিডিওপ্রমাণ
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রকাশিত প্রতিবেদন
সাক্ষীদের বর্ণনা, চিকিৎসকদের সাক্ষ্য ও জব্দ করা গুলিঃ
রায়ে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা ছিলেন অভিযুক্ত অপরাধগুলোর “মাস্টারমাইন্ড, পরিকল্পনাকারী এবং হুকুমদাতা।”
রায়ের আগে ট্রাইব্যুনাল এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাঃ
রায় ঘিরে সুপ্রিম কোর্ট ও ট্রাইব্যুনাল চত্বরজুড়ে কয়েক স্তরের নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সেনাবাহিনী, র্যাব, পুলিশ, এপিবিএন ও বিজিবিসহ গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন। ১৬ নভেম্বর সন্ধ্যার পর থেকে দোয়েল চত্বর ও আশপাশের সড়ক আংশিকভাবে বন্ধ রাখে পুলিশ।
জনাকীর্ণ আদালতকক্ষে আবেগঘন পরিবেশঃ
রায় ঘোষণার সময় আদালতকক্ষ জনাকীর্ণ হয়ে যায়। নিহতদের কয়েকজন পরিবারের সদস্য সেখানে কান্নায় ভেঙে পড়েন। রায় শেষে July Fighters এবং নিহত–আহতদের পরিবার স্লোগান দিয়ে উল্লাস প্রকাশ করলে অ্যাটর্নি জেনারেল সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ জানান।
ট্রাইব্যুনালের পুনর্গঠন ও বিচারপ্রক্রিয়ার টাইমলাইনঃ
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধের বিচারকাজের জন্য গঠিত এই ট্রাইব্যুনাল ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সরকার পরিবর্তনের পর পুনর্গঠিত হয়।নতুন ট্রাইব্যুনালে—
১৭ অক্টোবর শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
মার্চ ২০২৫—কামাল ও মামুনকে আসামি হিসেবে যুক্ত
১০ জুলাই—তিন আসামির বিরুদ্ধে পাঁচ অভিযোগে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু
১২–২৩ অক্টোবর—যুক্তিতর্ক
১৭ নভেম্বর—রায় ঘোষণা
মোট ৫৪ জন সাক্ষ্য দেন, যার মধ্যে আহত আন্দোলনকারী, প্রত্যক্ষদর্শী, চিকিৎসক ও তদন্ত কর্মকর্তারা ছিলেন।
অভিযোগগুলো যা ছিলঃ
১. উসকানিমূলক বক্তব্য দিয়ে সহিংসতা প্ররোচিত করা
২. ড্রোন, হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র দিয়ে আন্দোলনকারীদের নির্মূলের নির্দেশ
৩. বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাইদ হত্যায় নির্দেশনা
৪. চানখারপুলে ছয়জনকে হত্যা
৫. আশুলিয়ায় ছয়জনকে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ
রায় শোনার পর জনতার প্রতিক্রিয়াঃঃ
রায় উচ্চারণ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আদালতের
সামনে থাকা জনতা উত্তেজনায় ফেটে পড়েন। শহীদ পরিবারের অনেকে জানান—“আমরা আজ ন্যায়বিচারের দিন দেখলাম।”
এম.কে

