টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের তদন্তে বাংলাদেশি তদন্তকারীদের সহায়তা করছে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ)।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফ-এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিউলিপ একটি বিতর্কিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চুক্তি থেকে সুবিধা নিয়েছেন বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তার তদন্তে স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করতে ঢাকা ঘুরে গেছেন কয়েকজন ব্রিটিশ কর্মকর্তা।
অভিযোগ উঠেছে, টিউলিপ তার খালা ও গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাব ব্যবহার করেছেন।
গত মাসে একজন এথিকস অ্যাডভাইজার দেখতে পান, টিউলিপ এই কেলেঙ্কারি সম্পর্কে অনিচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন। এরপরই লেবার পার্টির নেতৃস্থানীয় পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয় তাকে।
ট্রেজারি মন্ত্রীর দায়িত্বে থাকার সময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার দায়িত্ব ছিল টিউলিপের। কিন্তু লন্ডনে নিজের ব্যবহৃত সম্পত্তি এবং সেগুলোর সঙ্গে শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার পর তিনি নিজেই বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এখন টিউলিপ, হাসিনা ও তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ৩.৯ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগের তদন্ত করছে।
এখন জানা গেছে, এই তদন্তে ব্রিটিশ পুলিশের সম্পৃক্ততা রয়েছে। অভিযোগ অনুযায়ী হাসিনা ও তার সহযোগীদের আত্মসাৎ করা অর্থ ফিরিয়ে আনায় সহায়তা করার জন্য এনসিএ গত বছরের অক্টোবরে প্রথমবার বাংলাদেশ সফর করে।
সূত্র বলছে, ব্রিটিশ কর্মকর্তারা বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করতে চান, যাতে মামলাটি বিচারের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে।
সূত্রের বরাত দিয়ে দ্য মেইল অন সানডে-র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই বৈঠক ইঙ্গিত দিচ্ছে, এনসিএ শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, যুক্তরাজ্যেও টিউলিপের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার জন্য তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। ব্রিটেনের ব্রাইবারি অ্যাক্ট ২০১০ অনুযায়ী, কেউ বিদেশে ঘুষ গ্রহণ করলে তার বিরুদ্ধে ব্রিটেনে মামলা এবং সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড হতে পারে।
ওই সূত্রের দাবি, বৈঠকে এনসিএ কর্মকর্তারা বিশেষভাবে টিউলিপকে নিয়ে প্রশ্ন করেছেন। তবে টিউলিপ সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
এনসিএ আন্তর্জাতিক ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্তের দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর একটি। সংস্থাটি যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করতে পারে। বিদেশে ব্রিটিশ নাগরিকদের বিরুদ্ধে ওঠা ঘুষ ও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তাদের।
গত আগস্টে রক্তক্ষয়ী অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশ ছেড়ে পালানো শেখ হাসিনা এখন ভারতে আছেন।
হাসিনার পতনের পর দুদক দেশের প্রধান ব্যাংকগুলোর কাছে টিউলিপ সিদ্দিকের অ্যাকাউন্ট ও লেনদেন-সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছে।
একটি অফিশিয়াল বিজ্ঞপ্তিতে, দুদক টিউলিপ ও তার ছয় পরিবারের সদস্যের আর্থিক লেনদেনের তথ্য চেয়েছে।
টিউলিপের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এই অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করা হয়নি। টিউলিপ সিদ্দিকের সঙ্গে এই বিষয়ে কেউ যোগাযোগ করেনি এবং তিনি সম্পূর্ণভাবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করছেন।’
এনসিএর এক মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা সাধারণত আন্তর্জাতিক সহায়তার ধরন সম্পর্কে মন্তব্য করি না। আর এজেন্সি কোনো তদন্ত শুরু করেছে কি না বা কোনো অংশীদার তদন্তে সহায়তা করছে কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত বা অস্বীকার করতেও পারি না।’
বাংলাদেশের দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা টেলিগ্রাফকে বলেন, ‘টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে তদন্ত এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। তবে আমরা সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করছি।
‘আমাদের প্রধান লক্ষ্য হলো বাংলাদেশে অবৈধ উপায়ে সম্পত্তি অর্জনের সঙ্গে তার কোনো সংযোগ আছে কি না, দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা এবং দেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে কি না, তা উদ্ঘাটন করা।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্য ও অন্যান্য দেশে পাচার হওয়া কয়েক বিলিয়ন ডলার চিহ্নিত করতে ব্রিটিশ সরকার এবং আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থাগুলোর সহায়তাকে আমরা অত্যন্ত মূল্যবান মনে করি।
‘এই অর্থ ফিরিয়ে আনা আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আর এ অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ওপর নির্ভর করছি। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে আমরা সরাসরি যোগাযোগ শুরু করেছি।’
তিনি বলেন, ‘এই প্রচেষ্টায় যুক্তরাজ্য আমাদের সহযোগিতা করছে। আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হলো বিভিন্ন দেশে—বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে—পাচার করা টাকায় কেনা সম্পত্তি ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করা। এই অর্থ ফেরত আনার জন্য এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
সূত্রঃ দ্য টেলিগ্রাফ
এম.কে
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫