দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সম্পর্ক ক্রমেই চাপে পড়ছে। এটি আর বিচ্ছিন্ন কোনো দ্বিপক্ষীয় সংকট নয়; বরং গোটা অঞ্চলে একটি কাঠামোগত পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ—সব দিকেই ভারতের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল হচ্ছে। বিশ্লেষকদের মতে, নিরাপত্তাকেন্দ্রিক কূটনীতি, আদর্শিক বক্তব্য এবং আক্রমণাত্মক রাজনৈতিক ভাষ্য এই আস্থাহীনতার মূল কারণ।
ভারতের ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ নীতি এক দশক আগে দক্ষিণ এশিয়ায় সহযোগিতা, সংযোগ ও বাণিজ্য বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে শুরু হয়েছিল। বাংলাদেশ, নেপাল ও মালদ্বীপে লাইন অব ক্রেডিট দিয়ে অবকাঠামো, জ্বালানি ও পরিবহন প্রকল্পে অর্থায়নের মাধ্যমে ভারত নিজেকে আঞ্চলিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানবিক সহায়তার মাধ্যমেও ভারতের ভূমিকা দৃশ্যমান ছিল।
তবে বাস্তবায়নের পর্যায়ে এই নীতি বড় ধাক্কা খায়।
বাংলাদেশ বিভিন্ন জটিলতার কারণে ভারতের ১১টি প্রকল্প বাতিল করে, নেপালেও অবকাঠামো প্রকল্পে একই ধরনের অভিযোগ ওঠে। এতে ভারতের সদিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বাস তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন ভারতের জন্য বড় কৌশলগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে আসা মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের ওপর দীর্ঘদিনের নির্ভরতা থেকে সরে এসে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছেন। এর মধ্যেই সমাজকর্মী শরীফ ওসমান হাদীর হত্যাকাণ্ড ঘিরে ভারতবিরোধী মনোভাব আরও তীব্র হয়।
হত্যাকারীরা ভারতে পালিয়েছে—এমন অভিযোগকে কেন্দ্র করে ঢাকায় ভারতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্থাপনায় হামলার ঘটনাও ঘটে, যদিও এসব দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ নেই।
নেপালের ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে আস্থার সংকট আরও পুরোনো। ২০১৫–১৬ সালের অর্থনৈতিক অবরোধের স্মৃতি এখনো কাঠমান্ডুর নীতিনির্ধারণে গভীর প্রভাব ফেলছে। সেই অভিজ্ঞতা নেপালকে ভারতের ওপর অতিনির্ভরতা কমাতে বাধ্য করে। এরই ধারাবাহিকতায় নেপাল চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ায় এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দেয়, ভারত ও চীনের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষার কৌশল গ্রহণ করে।
শ্রীলঙ্কাও একই পথে হাঁটছে। দীর্ঘদিনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণে দেশটি চীনের ওপর নির্ভরতা বাড়িয়েছে। বেইজিংয়ের আর্থিক ও কূটনৈতিক সহায়তা শ্রীলঙ্কার জন্য ভারতের ঐতিহ্যগত প্রভাবের বিপরীতে একটি বিকল্প শক্তি হিসেবে কাজ করছে।
মালদ্বীপের ক্ষেত্রে এই কৌশলগত পরিবর্তন সবচেয়ে স্পষ্ট। প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুইজ্জুর উত্থান ‘ইন্ডিয়া আউট’ আন্দোলনের মাধ্যমে, যেখানে ভারতীয় সামরিক উপস্থিতিকে সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরা হয়। ক্ষমতায় এসে তিনি ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেন এবং ২০২৪ সালের মে মাসে শেষ ভারতীয় সামরিক সদস্য মালদ্বীপ ছাড়ে। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ বাড়ছে, মালদ্বীপ এখন ভারতের ওপর অতিনির্ভরতা কমিয়ে বহুমুখী অংশীদারিত্বে জোর দিচ্ছে।
পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কার্যত স্থবির। সীমান্ত উত্তেজনা, ২০২৫ সালের মে মাসের সামরিক সংঘর্ষ এবং কূটনৈতিক সংলাপের অভাব দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে কাঠামোগতভাবে আটকে রেখেছে। আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতার চেষ্টাও এখন পর্যন্ত কার্যকর ফল আনতে পারেনি।
বিশ্লেষকদের মতে, এই আঞ্চলিক পুনর্গঠনের পেছনে দুটি বিষয় মুখ্য—আদর্শিক বক্তব্য ও নিরাপত্তাকেন্দ্রিক কূটনীতি। ‘অখণ্ড ভারত’-এর মতো প্রতীকী ধারণা এবং হিন্দুত্ববাদী ভাষ্য প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে ভারতের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ তৈরি করেছে। পাশাপাশি সীমান্তে সামরিক ঘাঁটি, ড্রোন নজরদারি ও ধারাবাহিক মহড়া কূটনৈতিক সম্পৃক্ততার জায়গা সংকুচিত করছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ৬২ বিলিয়ন ডলারের সম্ভাব্য আঞ্চলিক বাণিজ্য থাকলেও ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাসের কারণে ভারত এর অর্ধেকও কাজে লাগাতে পারছে না। ছোট রাষ্ট্রগুলো এখন এককভাবে ভারতের দিকে ঝুঁকে না পড়ে বড় শক্তিগুলোর মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করছে। এই বাস্তবতা স্পষ্ট করে দিচ্ছে—দক্ষিণ এশিয়া ধীরে ধীরে একটি বহুমুখী শক্তিকাঠামোর দিকে এগোচ্ছে, যেখানে ভারতের একক প্রভাব আর আগের মতো নিশ্চিত নয়।
সূত্রঃ দ্য ডিপ্লোম্যাট
এম.কে

