17.4 C
London
June 8, 2025
TV3 BANGLA
যুক্তরাজ্য (UK)

ধর্মীয় স্বাধীনতা বনাম পশ্চিমা মূল্যবোধঃ যুক্তরাজ্যের বিতর্কে মুসলমানরা কোথায় দাঁড়াচ্ছে?

যুক্তরাজ্যে হালাল মাংস ও বোরকা নিয়ে নতুন করে শুরু হওয়া বিতর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়। বহুদিন ধরে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত এই দুটি অনুষঙ্গ এখন মূলধারার রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রে চলে এসেছে। মুসলমানদের আশঙ্কা, ধর্মীয় স্বাধীনতার নামে প্রতিষ্ঠিত অধিকারগুলো যদি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বারবার প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়, তবে তা কেবল একটি সম্প্রদায়ের নয়, গোটা ব্রিটিশ গণতন্ত্রের সহনশীলতার ওপরই আঘাত হানবে।

সাম্প্রতিক একটি গুরুত্বপূর্ণ ই-পিটিশন ঘিরে হালাল মাংস নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধে। পিটিশনটিতে অজ্ঞান না করে পশু জবাই নিষিদ্ধ করার দাবি জানানো হয়েছে, যা ৯ জুন হাউজ অব কমন্সে আলোচনার জন্য তোলা হবে। ইতোমধ্যে এতে এক লাখের বেশি মানুষ স্বাক্ষর করেছেন। যদিও যুক্তরাজ্যের বর্তমান আইনে ধর্মীয় কারণে মুসলমানদের হালাল ও ইহুদিদের শেচিতা প্রথার ক্ষেত্রে অজ্ঞান না করেই জবাইয়ের অনুমতি রয়েছে।
পশু কল্যাণ সংগঠনগুলো দাবি করছে, অজ্ঞান না করে জবাই করা নিষ্ঠুর এবং তা ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালতের সাম্প্রতিক রায় অনুযায়ী অগ্রহণযোগ্য হলেও, ব্রিটিশ সরকারের অবস্থান অপেক্ষাকৃত মধ্যপন্থী। সরকারি তথ্যানুসারে, ৮৮ শতাংশ হালাল মুরগি এবং বেশিরভাগ গরু অজ্ঞান করেই ইসলামি বিধান অনুসারে জবাই করা হয়। এছাড়া, হালাল লেবেল সংক্রান্ত জালিয়াতির বিষয়টিও নতুন উদ্বেগ তৈরি করেছে, যেখানে কার্ডিফে এক বিক্রেতা হালাল নাম ব্যবহার করে ভুয়া মাংস বিক্রির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন।
বোরকা ইস্যুতে বিতর্ক শুরু করে ডানপন্থি রিফর্ম ইউকে পার্টি। ইউরোপের কিছু দেশের আদলে যুক্তরাজ্যেও মুখঢাকা পোশাক নিষিদ্ধ করার দাবি তুলেছে দলটি। এ নিয়ে দলটির অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরমে পৌঁছায় এবং দলীয় চেয়ারম্যান জিয়া ইউসুফ পদত্যাগ করেন। যদিও পরে তিনি ফের দলে ফিরে আসেন। পাশাপাশি কনজারভেটিভ দলের কিছু নেতাও এ ধরনের নিষেধাজ্ঞার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
রিফর্ম ইউকের নেতা নাইজেল ফারাজ ও এমপি লি অ্যান্ডারসনের মতো নেতারা মুখ খোলা রাখা জননিরাপত্তার জন্য আবশ্যক বলে দাবি করছেন। অন্যদিকে, লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ার স্টারমার পরিষ্কারভাবে জানিয়েছেন, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত পছন্দ রক্ষাই তাদের নীতি এবং তারা নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেন।
ধর্মীয় অধিকার রক্ষাকারীরা বলছেন, নারীদের পোশাকের স্বাধীনতা হরণ করা অসাংবিধানিক ও ইসলামভীতির বহিঃপ্রকাশ। অনেক ইসলামি চিন্তাবিদও বোরকাকে বাধ্যতামূলক পোশাক হিসেবে না দেখলেও, বিতর্কের ধরনটি মুসলিম নারীদের ব্যক্তিগত পছন্দের ওপর হস্তক্ষেপ হিসেবেই বিবেচিত হচ্ছে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে মুখ ঢাকার ওপর জাতীয় পর্যায়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা না থাকলেও, নিরাপত্তাজনিত কারণে নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে মুখ খোলার নিয়ম রয়েছে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই পুরনো বিষয়গুলো নতুন করে বিতর্কের কেন্দ্রে আসা একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। রিফর্ম ইউকের মতো ডানপন্থি দলগুলো ব্রিটিশ মূল্যবোধের নামে মুসলিমদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়কে টার্গেট করছে। উদ্দেশ্য হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভোটব্যাংককে সন্তুষ্ট করা এবং বহুসংস্কৃতিবাদকে প্রশ্নবিদ্ধ করা। হালাল মনিটরিং কমিটি (এইচএমসি) অভিযোগ তুলেছে, অজ্ঞান না করে জবাই নিয়ে ভুল তথ্য ছড়িয়ে মুসলিমদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে।
২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে প্রায় ৬ শতাংশ মুসলমান বসবাস করেন, যা প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। ২০০১ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ লাখ। বর্তমানে অর্ধেকের বেশি মুসলমান যুক্তরাজ্যেই জন্মেছেন এবং ৭৫ শতাংশ নিজেকে কেবল ব্রিটিশ পরিচয়ে পরিচিত করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। এই সম্প্রদায়ের একটি বড় অংশ ব্রিটিশ বাংলাদেশি, পাকিস্তানি ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তারা মনে করছেন, হালাল ও বোরকার মতো প্রথাগত অভ্যাস নিয়ে সন্দেহ ও বিধিনিষেধ আরোপ তাদের ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক জীবনে হস্তক্ষেপ।
মুসলিম অ্যাসোসিয়েশন অব ব্রিটেন (এমএবি) জানিয়েছে, ২০২৪ সালে ডানপন্থি উগ্রবাদী কার্যক্রমের পর থেকে ইসলামভীতি আবারও বেড়ে গেছে। দক্ষিণ এশীয় ও আফ্রিকান বংশোদ্ভূত মুসলমানরা চাকুরি, আবাসন ও শিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈষম্যের মুখোমুখি হচ্ছেন। এছাড়া, ইংল্যান্ড ও ওয়েলসের ৩৯ শতাংশ মুসলমান দেশের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকাগুলোতে বাস করেন, যেগুলো প্রায়শই জাতিগতভাবে ঘনবসতিপূর্ণ।
বিশ্লেষক ও সম্প্রদায় নেতারা বলছেন, এই বিতর্কগুলো কেবল ধর্মীয় স্বাধীনতার ওপরই আঘাত নয়, বরং যুক্তরাজ্যের বহুজাতিক ও সহনশীল সমাজব্যবস্থার ভবিষ্যতের জন্যও এক অশনিসংকেত।
সূত্রঃ সানডে টেলিগ্রাফ
এম.কে
০৮ জুন ২০২৫

আরো পড়ুন

ব্রেক্সিট ছিল একটি বড় ভুলঃ সাদিক খান

বোর্ডিং স্কুল নিয়ে বোমা ফোটালেন প্রিন্সেস ডায়ানার ছোট ভাই

বিলেতে বাড়ি কেনা-বেচাঃ লজার এবং ট্যানেণ্ট

নিউজ ডেস্ক