‘নো ওয়ান স্টে হিয়ার’—মাত্র চারটি শব্দের একটি টেক্সট বার্তা। কিন্তু এই চারটি শব্দই ছিল একটি সরকারের পতনের মুহূর্তে নেয়া সবচেয়ে গোপন, একপাক্ষিক ও আত্মরক্ষামূলক সিদ্ধান্তের প্রতীক। পাঠিয়েছিলেন স্বয়ং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু এই বার্তা দলের কোনো নেতাকর্মী কিংবা সরকারের উচ্চপর্যায়ের কারো কাছে যায়নি—গিয়েছিল কেবল বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের কাছে।
তথ্যসূত্রে জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট রাতেই শেখ হাসিনা নিশ্চিত হন তার সরকার টিকছে না। নিজের আতঙ্ক, শঙ্কা ও নিরাপত্তার বিষয়টি বুঝতে পেরে তিনি তখন তার পরিবারের সদস্যদের মধ্যে একটি মৌখিক এবং লিখিত নির্দেশ দেন—দেশ ত্যাগ করতে হবে।
পরদিন, ৪ আগস্ট, ভোররাতে আত্মীয়দের মোবাইলে এসে পৌঁছে সেই বার্তা: ‘No one stay here’. এই নির্দেশ পেয়েই অনেকে কারফিউ চলাকালেও দেশ ছেড়ে অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, কানাডা, সিঙ্গাপুর ও ভারতের দিকে পালিয়ে যান। পরে শেখ হাসিনা নিজে ছোট বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে ভারত চলে যান, এখন পর্যন্ত দিল্লিতে অবস্থান করছেন।
তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, আওয়ামী লীগের কোনো শীর্ষ নেতা, মন্ত্রী, এমপি কিংবা তৃণমূল কর্মী—কেউই এই বার্তা পাননি। তারা ছিলেন সম্পূর্ণ অন্ধকারে। অনেকে সরকারের পতনের পর গ্রেপ্তার হন, কারাগারে যান, অনেকে পালানোর সুযোগও পাননি।
অস্ট্রেলিয়ায় পালিয়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধু পরিবারের একজন সদস্য বলেন, “তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, সময় নেই—জীবন বাঁচাতে হবে। এই বার্তা শুধু আমাদেরই পাঠানো হয়েছিল। দলের কারো সঙ্গে এই তথ্য ভাগ করা হয়নি।”
এই ঘটনা আবারও তুলে ধরে আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের বাস্তবতা—দলীয় কর্মীরা শুধু রাজনৈতিক অস্ত্র, যাদেরকে প্রয়োজনে ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয়। বিপদের দিনে তাদের জন্য কোনো মেসেজ, কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা, কোনো পরামর্শ পর্যন্ত রাখা হয়নি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসও এই নির্দেশ পান বিমানবন্দরে—মুখে মুখে। তিনি সিঙ্গাপুর থেকে ফিরে এসেই আবার ফিরে যান।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে হত্যা, গুম, দুর্নীতি ও অর্থপাচারের একাধিক মামলা করেছে। বহু সাবেক মন্ত্রী, এমপি এখন কারাগারে। কিন্তু শেখ পরিবার ছিল সতর্ক, প্রস্তুত, এবং পলায়নপর।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, শেখ হাসিনা নিজে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ইতিহাস মনে করে সেই আতঙ্ক থেকেই হয়তো আত্মীয়দের দেশ ছাড়ার নির্দেশ দেন। কিন্তু তারা প্রশ্ন রাখেন—একটি দলীয় সরকারের পতনের মুহূর্তে নেতাকর্মীদের অন্ধকারে রেখে কেবল আত্মীয় বাঁচানোর এই চেষ্টা কি একজন গণতান্ত্রিক নেত্রীর পরিচায়ক?
সূত্রঃ খবরের কাগজ
এম.কে
১১ জুন ২০২৫