শুল্কমুক্ত কোটায় আমদানি করে খালাসের আগেই ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগের ২৪ জন সাবেক সংসদ সদস্যের গাড়ি নিলামে তুলেছিল চট্টগ্রাম কাস্টমস। এর মধ্যে নয়টি গাড়ি নিলামে কেনার জন্য কেউই আগ্রহ দেখাননি। বাকি ১৫টি গাড়ি কেনার আগ্রহ জানিয়ে যারা নিলামে অংশ নেন তাদের প্রস্তাবিত দর রিজার্ভ ভ্যালুর ৬০ শতাংশের শর্ত পূরণ করেনি।
এ অবস্থায় সাবেক সংসদ সদস্যদের গাড়িগুলো নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত আপাতত ‘ঝুলে গেল’ বলে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। সোমবার (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ২টায় চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তাদের অকশন শেডে নিলাম বাক্স খুলে অংশগ্রহণকারীদের প্রস্তাবিত দর যাচাই-বাছাই করে।
শুল্কমুক্ত কোটায় বিলাসবহুল এসব গাড়ির আমদানিকারক সাবেক সংসদ সদস্যদের কেউ আত্মগোপনে, কেউ গ্রেফতার হয়ে কারাগারে আছেন। কয়েকদফা তাগাদার পরও খালাস না নেয়ায় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ সেগুলো নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়।
গত ২৭ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে সাবেক সংসদ সদস্যদের ২৪টিসহ মোট ৪৪টি গাড়ি নিলামে বিক্রির ঘোষণা দেয়। একইসঙ্গে আগ্রহী ক্রেতাদের কাছ থেকে নিলামের প্রস্তাবিত দর গ্রহণ শুরু করে। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ আমদানি ব্যয় ও শুল্ক মিলিয়ে গাড়িগুলোর সংরক্ষিত দর নির্ধারণ করে ৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। প্রথম নিলামে অংশ নিয়ে গাড়ি কিনতে হলে তাকে রিজার্ভ ভ্যালুর ৬০ শতাংশ বা তার বেশি সর্বোচ্চ দরদাতা হতে হবে। এ হিসেবে প্রতিটি গাড়ি কিনতে ন্যূনতম ৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা দর দিতে হবে। ২৫ শতাংশ করসহ এই গাড়ির সর্বনিম্ন দাম পড়বে ৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা।
১৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনলাইনে এবং ঢাকা-চট্টগ্রামে সরাসরি বাক্সে নিলামের প্রস্তাবিত দর গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে ২ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গাড়িগুলো নিলামে অংশগ্রহণকারীদের জন্য সরাসরি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এরপর সোমবার নিলামে অংশগ্রহণকারীদের প্রস্তাবিত দর উন্মুক্ত করা হয়।
কাস্টমস কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী, নিলামে তোলা ৪৪টি গাড়ির মধ্যে ২৪টি সাবেক সংসদ সদস্যরা শুল্কমুক্ত কোটায় এনেছেন। এর মধ্যে অধিকাংশই ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর থেকে জুলাই পর্যন্ত সময়ের মধ্যে আনা। এসব গাড়ির সবগুলোই টয়োটা ব্র্যান্ডের ল্যান্ড ক্রুজার।
যেসব সাবেক সংসদ সদস্যের গাড়ি নিলামে তোলা হয়েছে, তারা হলেন- মোহাম্মদ সাদিক (সুনামগঞ্জ-৪), এস এ কে একরামুজ্জামান (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-১), মো. নাসের শাহরিয়ার (ঝিনাইদহ-২), জান্নাত আরা হেনরী (সিরাজগঞ্জ-২), শাহ সরোয়ার কবীর (গাইবান্ধা-২), মো. মজিবুর রহমান মঞ্জু (বগুড়া-৫), মো. তৌহিদুজ্জামান (যশোর-২), এস এম কামাল হোসাইন (খুলনা-৩), আবুল কালাম আজাদ (জামালপুর-৫), সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী (ফরিদপুর-২), আকতারুজ্জামান (গাজীপুর-৫), মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহেদ (ময়মনসিংহ-১১), আব্দুল মোতালেব (চট্টগ্রাম-১৫), সানজিদা খানম (সংরক্ষিত আসন-৩২), মোহাম্মদ আলী আরাফাত (ঢাকা-১৭), মো. আসাদুজ্জামান (রংপুর-১), মো. সাদ্দাম হোসাইন (নীলফামারি-৩), মো. সাইফুল ইসলাম (ঢাকা-১৯), এবিএম আনিসুজ্জামান (ময়মনসিংহ-৭), সাজ্জাদুল হাসান (নেত্রকোণা-৪), তারানা হালিম (সংরক্ষিত আসন-১৮), রুনু রেজা (সংরক্ষিত আসন-১২), শাম্মী আহমেদ (সংরক্ষিত আসন-১৭) এবং সুরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী (নওগাঁ-৩)।
কাস্টমস কর্মকর্তারা জানান, নিলামে তোলা ৪৪টি গাড়ির মধ্যে ৩৫টি গাড়ির বিপরীতে ১৪৩টি আবেদন ও দরপ্রস্তাব জমা পড়ে। এর মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্যদের ২৪টি গাড়ির মধ্যে নয়টির জন্য কোনো আবেদন ও দরপ্রস্তাব জমা পড়েনি। বাকি ৩৫টি গাড়ির মধ্যে সাবেক সংসদ সদস্য এস এম কামাল হোসেনের আমদানি করা গাড়িটির দর উঠেছে তিন কোটি ১০ লাখ টাকা। এটিই সব গাড়ির মধ্যে সর্বোচ্চ দর। শুল্কমুক্ত সুবিধার বাইরে আমদানি করা ২০টি গাড়ির দর উঠেছে দুই লাখ থেকে এক কোটি ৩৭ লাখ টাকার মধ্যে।
চট্টগ্রাম কাস্টমসের নিলাম শাখার সহকারী কমিশনার মো. সাকিব হোসেন বলেন, ‘৪৪টি গাড়ির মধ্যে রিজার্ভ ভ্যালুর ৬০ শতাংশ কাভার করেছে এমন গাড়ি মাত্র ১৪-১৫টি। সুতরাং বিট করলেই গাড়ি পাবার নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না। এ বিষয়ে নিলাম কমিটির পরবর্তী সভায় সিদ্ধান্ত হবে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আরও সময় লাগবে।’
জানা গেছে, সাবেক সংসদ সদস্যদের গাড়িগুলো কেনার আগ্রহ দেখিয়ে দরপত্র জমা দেয় ৩২ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে আছে- এস এ ট্রেডিং এন্ড কোম্পানি, কেডিএস গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ফারজানা ট্রেডিং, চট্টগ্রাম কাস্টম বিডার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ এয়াকুব চৌধুরী, মহসিন মোহম্মদ কবীর ও এস এম আরিফ, ভ্যানগার্ড গার্মেন্টস লিমিটেড, ল্যাবএইড লিমিটেড, রেডিয়েন্ট বিজনেস কনসর্টিয়াম লিমিটেড, কনকর্ড প্রগতি কনসোর্টিয়াম, এ ই কনস্ট্রাকশন লিমিটেড, ক্রয়ডন- কাউলুন ডিজাইন লিমিটেড, এয়ারোউইং এভিয়েশন লিমিটেড, তারাসিমা অ্যাপারেলস লিমিটেড, ইজি সার্ভিসেস লিমিটেড, মের্সাস আল-জাজিরা ট্রেডিং এবং ফারাজ আব্দুর রহিম।
উল্লেখ্য, আমদানি করা পণ্য জাহাজ থেকে খালাস করে বন্দর ইয়ার্ডে রাখার ৩০ দিনের মধ্যে আমদানিকারককে সরবরাহ নিতে হয়। এ সময়ের মধ্যে কোনো আমদানিকারক পণ্য সরবরাহ না নিলে তাকে নোটিশ দেয় কাস্টমস। নোটিশ দেওয়ার ১৫ দিনের মধ্যে পণ্য সরবরাহ না নিলে নিয়ম অনুযায়ী সেটা নিলামে তুলতে পারে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।
এম.কে
১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫