TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক চুক্তিতে বাংলাদেশঃ উদ্বিগ্ন ভারত

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাম্প্রতিক দুটি ঘোষণায় স্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে—নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বৃহস্পতিবার সকালে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর জয়েন্ট চিফস অব স্টাফ কমিটির চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার নেতৃত্বে আট সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় পৌঁছায়। একইদিনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, দুই দশক পর স্থগিত থাকা বাংলাদেশ–পাকিস্তান যৌথ অর্থনৈতিক কমিশনের বৈঠক আগামী ২৭ অক্টোবর ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বেদনাময় ইতিহাস এই সম্পর্ককে দীর্ঘদিন ছায়া দিয়ে রেখেছে। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ইউনুস সরকার যে গতিতে পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকছে, তা বাংলাদেশের সমাজে নতুন বিভাজন তৈরি করেছে। পাকিস্তানের সঙ্গে সামরিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের চেষ্টা এখন জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু।

গত আগস্টে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহাম্মদ ইশাক দারের ঢাকা সফরে দুই দেশের মধ্যে সরকারি ও কূটনৈতিক পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসামুক্ত ভ্রমণ চুক্তি হয়। পাশাপাশি পাকিস্তান ঘোষণা দেয়, আগামী পাঁচ বছরে ৫০০টি বৃত্তি বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দ করবে, যার এক-চতুর্থাংশ চিকিৎসা শিক্ষার জন্য নির্ধারিত। এই সফরের মধ্য দিয়েই দুই দেশের সম্পর্ক নতুন মাত্রা পায়, এবং এখন সেই সম্পর্ক সামরিক পর্যায়েও সম্প্রসারিত হচ্ছে।

অবসরপ্রাপ্ত এক বাংলাদেশি জেনারেল বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আগমন “রাজনৈতিক নয়, নিরাপত্তা ঝুঁকির” বার্তা বহন করছে। তার মতে, “তাদের সেনাবাহিনী চীনের প্রভাবাধীন, তারা কোনো কিছু নিঃস্বার্থভাবে দেয় না। বরং এই প্রশিক্ষণ বিনিময়ের আড়ালে ধর্মীয় উগ্রতা ও ভারতবিরোধী মনোভাব ঢুকে পড়তে পারে।” তিনি সতর্ক করেন, “অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ঘোষিত ‘প্রাইভেট মিলিশিয়া’ পরিকল্পনার সঙ্গে পাকিস্তানি প্রশিক্ষণ যুক্ত হলে তা হবে এক ভয়ংকর ভুল।”

অন্যদিকে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ভূপ্রকৃতি, সামরিক কাঠামো এবং সীমান্ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে পাকিস্তান থেকে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের বাস্তব সুফল নেই। বরং ভারত–পাকিস্তান উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ঢাকা–ইসলামাবাদ ঘনিষ্ঠতা আঞ্চলিক নিরাপত্তাকে আরও জটিল করতে পারে।

ভারতের উদ্বেগ বাড়ছে পাকিস্তানি নাগরিকদের আগমন ও আইএসআই–এর সম্ভাব্য সক্রিয়তা নিয়ে। বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পণ্যের শারীরিক পরিদর্শন বাধ্যতামূলকতা তুলে দিয়েছে, যা ভারতীয় নিরাপত্তা মহলে আশঙ্কা তৈরি করেছে যে অস্ত্র ও গোলাবারুদ বাংলাদেশে ঢুকতে পারে। এরই মধ্যে অর্থনৈতিক মন্দা, আইএমএফ ঋণ নির্ভরতা ও বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাসের কারণে বাংলাদেশের অর্থনীতি চাপের মুখে।

একজন পোশাক শিল্প উদ্যোক্তা বলেন, “কারখানা বন্ধ হচ্ছে, অর্ডার বাতিল হচ্ছে, হাজারো শ্রমিক বেকার হচ্ছে। সরকার বলছে অর্থনীতি ভালো, কিন্তু আমরা মাটিতে ভিন্ন বাস্তবতা দেখছি। এখন আবার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে—যাদের নিজেরাই ঋণ আর সংকটে জর্জরিত।”

সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, দুই দেশের বাণিজ্য সম্পর্ক “অসম ও সীমিত।” তার মতে, ৮৬৫ মিলিয়ন ডলারের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের মধ্যে পাকিস্তান রপ্তানি করে ৭৭৮ মিলিয়ন ডলারের পণ্য। “বাংলাদেশ কী লাভ করছে?” প্রশ্ন তোলেন তিনি। করাচি–চট্টগ্রাম নৌপথ খুলে দেওয়া হলেও “কোনো আমদানিকারক তাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না,” দাবি করেন নওফেল।

তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানের বৃত্তি ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি বাংলাদেশের তরুণদের আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হয়েছে। “আমরা ভাষা ও সংস্কৃতিতে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বেশি ঘনিষ্ঠ, পাকিস্তানের সঙ্গে নয়,” বলেন তিনি। এই মনোভাব প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা ফজলুর রহমানসহ সাধারণ নাগরিকদের মধ্যেও, যারা মনে করেন পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুজ্জীবিত করা “শহীদদের আত্মত্যাগের প্রতি অবমাননা।”

তবে ইউনুস সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু মহল পাকিস্তানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্কের পক্ষে। জামায়াত ঘরানার প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহিল আমান আজমি ও কর্নেল আবদুল হকসহ কয়েকজন পাকিস্তানপন্থী কর্মকর্তা এই সম্পর্ককে “ভারতবিরোধী ভারসাম্য নীতি” হিসেবে তুলে ধরছেন। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সেনাপ্রধান, নৌপ্রধান এবং পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠকও এ দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইউনুস পাকিস্তান কার্ড খেলছেন মূলত অভ্যন্তরীণ শক্তিগোষ্ঠী—বিশেষ করে সামরিক মহল ও ইসলামপন্থী দলগুলোকে তুষ্ট রাখতে। তবে অর্থনীতিবিদ শাহাব এনাম খান বলেছেন, “বাংলাদেশের বাণিজ্য বৈচিত্র্য প্রয়োজন। পাকিস্তান বিকল্প হতে পারে, কিন্তু প্রতিরক্ষা সহযোগিতা এখনই গভীর হওয়ার সম্ভাবনা কম।”

ইউনুস সরকারের পাকিস্তানমুখী কূটনীতি এখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও জনমনে নতুন প্রশ্ন তুলেছে—এই নীতি কি উন্নয়ন, নাকি রাজনৈতিক বেঁচে থাকার কৌশল?

সূত্রঃ দ্য ইন্ডিয়ান টেলিগ্রাফ

এম.কে

আরো পড়ুন

ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই লন্ডনে যেতে পারেন খালেদা জিয়া

রাজা চার্লসের অভিষেক কুচকাওয়াজে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর ১০ সদস্য

বাংলাদেশের মানুষকে সুলভমূল্যে বিদ্যুৎ দিতে চায় চীন