বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ক্যান্সার রোগীরা প্রমাণভিত্তিক চিকিৎসা উপেক্ষা করে তথাকথিত ‘প্রাকৃতিক চিকিৎসা’র প্রতি ঝুঁকে পড়ছেন। চিকিৎসকরা বলছেন, অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ভুল ও বিভ্রান্তিকর তথ্যের কারণে অনেক রোগী জীবন রক্ষাকারী চিকিৎসা গ্রহণে বিলম্ব করছেন বা তা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করছেন, যার ফলে কেউ কেউ অকালমৃত্যুর শিকার হচ্ছেন। এই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে অনুষ্ঠিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্যান্সার সম্মেলন, আমেরিকান সোসাইটি অফ ক্লিনিক্যাল অঙ্কোলজি (Asco)-এর বার্ষিক সভায়।
হিউস্টনের এমডি অ্যান্ডারসন ক্যান্সার সেন্টারের ক্যান্সার গবেষক ও সহকারী অধ্যাপক ড. ফুমিকো চিনো উপস্থাপিত এক গবেষণায় জানানো হয়, গত এক দশকে ক্যান্সার সম্পর্কিত ভুল তথ্য অনলাইনে বিপজ্জনকভাবে বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় অর্ধেক মানুষ মনে করেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের বক্তব্য একে অপরের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এবং প্রতি ২০ জনে একজন বিজ্ঞানীদের ওপর আস্থা হারিয়েছেন। ড. চিনো বলেন, “আমরা তথ্যযুদ্ধে পিছিয়ে যাচ্ছি। আমাদের রোগীদের কাছে আবার সত্যি পৌঁছে দিতে হবে।”
আমেরিকান সোসাইটি অফ ক্লিনিক্যাল অঙ্কোলজি-এর চিফ মেডিকেল অফিসার ড. জুলি গ্রালো বাস্তব অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, অনেক রোগী অনলাইনে তথাকথিত ‘প্রাকৃতিক চিকিৎসা’ খুঁজে পান এবং প্রমাণহীন ক্লিনিকের প্রলোভনে পড়ে চিকিৎসা গ্রহণ করেন। “আমি এমন রোগী পেয়েছি, যারা মেক্সিকোর একটি ক্লিনিকে গিয়েছিলেন যেখানে ক্যান্সার নিরাময়ের নামে কফি এনিমা, ভিটামিন সি ইনফিউশন ইত্যাদি প্রয়োগ করা হয়। তারা কয়েক মাস পর ফিরে এসে বলেন, শরীরের অবস্থা ভালো নয়। তখন আমরা ধীরে ধীরে তাদের প্রমাণিত চিকিৎসায় নিয়ে আসার চেষ্টা করি। তবে কেউ কেউ আর ফেরেন না, পরে জানা যায় তারা মৃত্যুবরণ করেছেন।”
অবসরপ্রাপ্ত স্তন ক্যান্সার সার্জন লিজ ও’রিদান,জানান—সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্যান্সার নিয়ে বিপুল পরিমাণ ভুল তথ্য ঘুরছে। “প্রতিদিনই আমি বার্তা পাই—নারীরা জানতে চান দুধ খাওয়া, সয়া বা ফ্ল্যাক্সসিড গ্রহণ করা কি বিপজ্জনক, আন্ডারওয়্যার ব্রা বা ডিওডোরেন্ট কি ক্যান্সার বাড়ায়, কিংবা জুস খেয়ে ক্যান্সার সারে কিনা। এসব প্রশ্ন বোঝায় যে মানুষ কী রকম ভয় ও বিভ্রান্তির মধ্যে রয়েছেন।”।
তিনি আরও বলেন, “আমরা চিকিৎসকেরা অলৌকিক নিরাময়ের প্রতিশ্রুতি দিতে পারি না, কিন্তু প্রমাণিত চিকিৎসার পেছনে আছে গবেষণা, আর বাঁচার সম্ভাবনা।”
ম্যাকমিলান ক্যান্সার সাপোর্টের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ড. রিচার্ড সিমকক বলেন, “আমি সম্প্রতি দুই তরুণীকে দেখেছি যারা সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত তথাকথিত ‘প্রাকৃতিক পথ’ গ্রহণ করে সমস্ত চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করেছে। একজন রোগীর চিকিৎসা গ্রহণ না করার অধিকার আছে, কিন্তু যদি তার ভিত্তি হয় ভুল তথ্য, তা হলে সেটা অত্যন্ত দুঃখজনক।”
তিনি বলেন, “আমাদের দায়িত্ব এখন রোগীদের আস্থা ফিরিয়ে আনা—যাতে তারা সামাজিক মাধ্যমের বিভ্রান্তিকর প্রচারণায় না হারিয়ে যায়।”
এনএইচএস ইংল্যান্ডের জাতীয় মেডিকেল পরিচালক অধ্যাপক স্টিফেন পাউইসও জানান, সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কখনো কখনো রোগীরা সহানুভূতিশীল কমিউনিটি পান, কিন্তু একই সঙ্গে তারা পড়ে যাচ্ছেন বিপজ্জনক ভুল তথ্যে। এই মিরাকল কিউর বা অলৌকিক নিরাময়ের গল্পগুলো যেন গল্পেই সীমাবদ্ধ থাকে। এগুলো অনেক সময় প্রাণঘাতী হয়ে উঠতে পারে।”
পাউইস জনগণকে আহ্বান জানান, ক্যান্সার সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য যাচাই করতে NHS ওয়েবসাইট বা চিকিৎসক দলের সঙ্গে যোগাযোগ করার।
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
০৩ জুন ২০২৫