যুক্তরাজ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষ সমর্থনে বিক্ষোভ করায় দুইজন এনএইচএস কর্মীকে কর্মস্থলে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এক তদন্তে দেখা গেছে, অভিযুক্ত দুই কর্মীর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগের ভিত্তি নেই এবং ট্রাস্ট নিজস্ব শৃঙ্খলানীতিই লঙ্ঘন করেছে বলে জানায় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদন।
দুই এনএইচএস পেশাজীবীকে ফিলিস্তিনের পক্ষে একটি শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ আয়োজনের আগ্রহ প্রকাশ করায় তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়েছে এবং তাদের কর্মস্থল থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
এনএইচএসের এক থেরাপিস্ট ও নার্সের নামে অভিযোগ করা হয়, তারা কেনসিংটন ও চেলসি শিশু ও কিশোর মানসিক স্বাস্থ্য পরিষেবার কর্মীদের “নিরাপত্তার জন্য হুমকি” সৃষ্টি করেছেন এবং বিক্ষোভের পরিকল্পনার মাধ্যমে ট্রাস্টের সুনাম ক্ষুণ্ন করেছেন।
গার্ডিয়ান এই দুই কর্মীকে লায়লা ও মায়া নামে উল্লেখ করেছে। তাদের জানানো হয় যে, তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত হবে এবং নতুন এনএইচএস কর্মস্থলে পুনর্বহাল না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের বর্তমান ভবনে প্রবেশ করতে পারবেন না।
তিন মাসের তদন্ত শেষে দেখা যায়, তাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি এবং এনএইচএস ট্রাস্ট তাদের প্রতি শৃঙ্খলানীতি লঙ্ঘন করেছে।
তদন্তকারীরা বলেন, লায়লা ও মায়ার ইচ্ছা ছিল না সহকর্মীদের ওপর কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগ করা বা তাদের ভয় দেখানো।
লায়লা ও মায়া সেন্ট্রাল অ্যান্ড নর্থ ওয়েস্ট লন্ডন এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ অভিযোগ দায়ের করেন, যেখানে জানানো করা হয়, তাদের প্রতি ট্রাস্টের আচরণ শৃঙ্খলানীতির লঙ্ঘন ছিল।
একজন ট্রাস্ট মুখপাত্র বলেন, “আমরা ব্যবস্থাপকদের সহায়তা করি যাতে নিরাপদ পরিবেশ বজায় রাখা যায়। আমাদের ক্লিনিকগুলোর কার্যক্রম ব্যাহত হয় এমন কোনো কর্মকাণ্ড ঠেকানো সর্বাত্মক চেষ্টা করাই আমাদের কাজ।”
লায়লা ও মায়া এখন তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ এনে একটি শ্রম আদালতে মামলা দায়ের করেছেন, যেখানে তারা দাবি করেছেন, তাদের অ্যান্টি-জায়োনিস্ট (বিরোধী-জায়োনিস্ট) বিশ্বাসের কারণে বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে।
এই মামলা এনএইচএস কর্মীরা কতটা স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ করতে পারেন, বিশেষ করে বিদেশ নীতির বিষয়ে, সে সম্পর্কে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।
লায়লা ও মায়া একটি “ফ্রি প্যালেস্টাইন” নামক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করেছিলেন, যেখানে কর্মীদের মধ্যে আলোচনা চলছিল , কর্মস্থলে রোগী পরিষেবার ক্ষতি না করেই কোনো প্রতীকী প্রতিবাদ বা সমাবেশ করা সম্ভব কি না।
লায়লা বলেন, “আমরা ম্যানেজমেন্টের অনুমতি না নিয়ে কিছু করতাম না। আমরা দেখেছি, হোমারটন ও সেন্ট জর্জ হাসপাতালের কর্মীরা লাঞ্চ ব্রেকের সময় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে। আমরা শুধু আলোচনা করছিলাম, আমাদের পক্ষে কী শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করা সম্ভব হতে পারে।”
এটি নিয়ে এক সহকর্মীর সাথে তাদের কথা হয়। ঐ সহকর্মী এতে অস্বস্তি অনুভব করেন এবং একটি অভিযোগ দায়ের করেন।
গার্ডিয়ানের হাতে থাকা অভিযোগপত্র অনুসারে, অভিযোগকারী জানান, লায়লা তাকে জানান যে, কর্মীদের মধ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে সংহতি জানিয়ে কর্মবিরতি বা প্রতিবাদ নিয়ে আলোচনা চলছে। অভিযোগকারী তখন জানতে চান, “এটি কেন কর্মস্থলে করতে হবে?”
লায়লা উত্তর দেন যে, “এটি ইসরাইল সরকারের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনের সমর্থনে, তবে এটি ইহুদি-বিরোধী কিছু নয়।”
অভিযোগকারী আরও বলেন, “আমি শুনেছি, আরও কয়েকজন কর্মী এতে অংশ নিতে চাচ্ছেন, যা আমাদের ক্লিনিকে আসা ইহুদি ও ইসরায়েলি শিশু ও অভিভাবকদের জন্য পীড়াদায়ক হতে পারে।”
বিক্ষোভটি বাস্তবে হয়নি। কিন্তু পরের দিন ব্যবস্থাপনা কর্মীদের ই-মেইল পাঠিয়ে সতর্ক করে যে, “কাজের সময়ে বিক্ষোভে অংশগ্রহণ ট্রাস্ট নীতির লঙ্ঘন হতে পারে।”
কয়েকদিন পর, মায়াকে হঠাৎ করে এক আলাদা কক্ষে ডেকে বলা হয় যে, তিনি তদন্তাধীন এবং তাকে অবিলম্বে কাজ ছেড়ে চলে যেতে হবে। পরের দিন একই ঘটনা ঘটে লায়লার সাথেও। তাদের দুজনকেই কর্মস্থলে নিষিদ্ধ করা হয় এবং অন্যত্র স্থানান্তর করা হয়।
মায়া মানসিক চাপে তিন সপ্তাহ অসুস্থতার জন্য ছুটি নেন, আর লায়লা শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে দ্রুত ওজন হারাতে থাকেন।
লায়লা ও মায়া যখন পুনর্বহাল হওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তখন তারা জানতে পারেন, ম্যানেজমেন্ট তাদের সহকর্মীদের জিজ্ঞাসা করছিল “তারা ইহুদি রোগীদের চিকিৎসা করতে নিরাপদ কি না।”
লায়লা তদন্ত চলাকালীন সময়ে পদত্যাগ করেন বলেও জানা যায়। লায়লাকে তার সহকর্মীরা বিদায় জানাতে গেলেও বাঁধা দেওয়া হয়।
লায়লা বলেন, ” আমার সুপারভাইজার আমাকে বলেন আমি যেন বিল্ডিংয়ের বাইরে রাস্তায় এসে আমার জিনিসপত্র নিয়ে যাই। তারা আমাকে একজন অপরাধীর মতো আচরণ করে।”
মায়া অভিযোগ করেন, “আমার কাজে ফিরে আসার পর আমাকে জ্যাকেট থেকে ফিলিস্তিনের ব্যাজ সরিয়ে ফেলতে বলা হয়, কারণ এটি রাজনৈতিক প্রতীক। কিন্তু আমি অন্য কর্মীদের পোস্তফুল, ইউক্রেন বা লেবার পার্টির ব্যাজ পরতে দেখেছি।”
গত বছর একটি শ্রম আদালত রায় দিয়েছিল, “ইসরাইলের কর্মকাণ্ডকে বর্ণবাদ, জাতিগত নিধন ও গণহত্যা বলে বিশ্বাস করাকে গণতান্ত্রিক সমাজে সম্মানের যোগ্য মতামত হিসেবে গণ্য করা উচিত।”
ফেব্রুয়ারি ২০২৪ সালে, একটি রায়ে আদালত বলেছিল যে, অধ্যাপক ডেভিড মিলারকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বরখাস্ত করা অন্যায় ছিল, কারণ তার অ্যান্টি-জায়োনিস্ট মতাদর্শ ছিল। আদালত ঘোষণা করে যে, বিরোধী-জায়োনিস্ট মতাদর্শ যুক্তরাজ্যের সমতা আইনের অধীনে সংরক্ষিত মতবাদ।
সেন্ট্রাল অ্যান্ড নর্থ ওয়েস্ট লন্ডন এনএইচএস ফাউন্ডেশন ট্রাস্টের এক মুখপাত্র বলেন:
“মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত ও অন্যান্য বিশ্ব ঘটনাগুলো আমাদের কর্মী, রোগী ও সম্প্রদায়ের ওপর নানা প্রভাব ফেলছে। আমরা স্বাধীন সমাজে বৈধ প্রতিবাদকে সমর্থন করি, তবে এনএইচএসকে এমন একটি নিরাপদ জায়গাও রাখতে চাই যেখানে কর্মীরা রোগীদের যত্নে মনোযোগ দিতে পারেন। আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার হচ্ছে সেরা চিকিৎসাসেবা দেওয়া এবং নাগরিকতা, সম্মান ও সহযোগিতার নীতিগুলো বজায় রাখা।”
(নিবন্ধে উল্লিখিত নামগুলো পরিবর্তিত হয়েছে)
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫