স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় (২০১৩-২০২৩) প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোহাম্মদ আবদুল হামিদ অ্যাডভোকেট। সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্র সর্বোচ্চ পদে থাকার সুবাদে রাষ্ট্রীয় সম্পদ বঙ্গভবনকে ব্যবহার করেন পৈতৃক ভিটার মতো। সহজ-সরল কখনো অশ্লীল বাক্যালাপে আনুষ্ঠানিক বক্তৃতায় রসের যোগান দিতেন আবদুল হামিদ। তার এই সহজিয়া অবয়বের ভেতর লুকিয়ে ছিলো লালসার কুৎসিত মানস।
সরকারি খরচে রাষ্ট্রীয় বঙ্গভবনের ভেতর নির্মাণ করেন রঙমহল। স্থাপন করেন সুইমিংপুলসহ নানা স্থাপনা। হামিদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বঙ্গভবনের দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারা গড়ে তোলে বঙ্গভবন কেন্দ্রিক অর্থ লোপাটের সিন্ডিকেট। আবদুল হামিদের ব্যক্তিগত সহকারী ও সচিব সম্পদ বড়ুয়া, প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীন, উপ-সচিব জান্নাতুন নাঈম, গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী স্বর্ণেন্দু শেখর মন্ডল, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মেহেদী রায়হান নাদিম সকলেই ছিলেন আবদুল হামিদের সিন্ডিকেট সদস্য।
সমস্ত নিয়ম-নীতি উপেক্ষা করে তারা আবদুল হামিদের মনোবাঞ্ছা হাসিলে নিবিষ্ট থাকতেন। আব্দুল হামিদের প্রাত্যহিক কর্মসূচি সম্পর্কে জানা যায়, প্রতিদিন সন্ধ্যার পর অফিসিয়াল কার্যক্রম শুরু করতেন তিনি। এ সময় তার একান্ত ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ছাড়া কেউ অবস্থান করতে পারতেন না।
আব্দুল হামিদের প্রধান কাজই ছিল বিভিন্ন সরকারি দফতরে নিয়োগ, বদলি বাণিজ্যের তদবির। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রেসিডেন্ট পদাধিকার বলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। এ পদাধিকার ব্যবহার করে তিনি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নিয়োগসহ বিভিন্ন নিয়োগ বাণিজ্য করতেন। রাত ১১টার পর বঙ্গভবনের মূল কমপ্লেক্সে জমতো আসর। এ আসরে প্রায়ই উপস্থিত থাকতেন ডিবি হারুন ও তার ঘনিষ্ঠরা।
বিষয়টি নিয়ে বঙ্গভবনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্য কানাঘুষা চলতো। পরিকল্পনা অনুযায়ী আবদুল হামিদ পরিবারের বিনোদনের জন্য বঙ্গভবনের মূল ভবনের পেছনে রাত্রি যাপনের উদ্দেশ্যে নির্মাণ করা হয় পৃথক কক্ষ। সুইমিংপুল কমপ্লেক্স নির্মাণের প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হয়। প্রকল্পটির প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয় ৮ কোটি টাকা। পরে এটি বাড়িয়ে ২০ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। আবদুুল হামিদের এ প্রকল্প থেকে সচিব সম্পদ বড়ুয়াসহ তার ঘনিষ্ঠরা অন্তত ১০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
বঙ্গভবনের ভেতরে রয়েছে একটি জাদুঘর বা তোষাখানা। এটি সংস্কারের নামে প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এখান থেকেই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন হামিদ পরিবারের ঘনিষ্ঠরা। বঙ্গভবনের বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্পৃক্ত ছিলেন তৎকালীন প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব গোপালগঞ্জের মেজর জেনারেল (অব.) সালাউদ্দিন ইসলাম।
সুইমিংপুল নির্মাণের পর থেকেই রীতিমতো রঙমহলে পরিণত হয় রাষ্ট্রীয় বঙ্গভবন। কেপিআই এলাকার ভেতরই চলে রসিক আবদুল হামিদের রঙলীলা। যেখানে উঠতি নতুন মডেলদের নিয়ে নিয়মিত প্রায়ই শরীক হতেন ডিবি হারুন, গানের আসরও বসতো। গভীর রাত অবধি চলতো সেই আসর। অন্দরের রঙ মহলের নূপুর নিক্কন কর্মরত কর্মচারীদের কানেও ভেসে আসতো। প্রেসিডেন্ট সাহাবুদ্দিন বঙ্গভবনের বাসিন্দা হওয়ার পর বন্ধ হয় সেই রঙ মহল।
রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয় ও লুটপাটে এ যুগের তুঘলক আবদুল হামিদের জুড়ি মেলা ভার। পরিবেশবিদদের মতামত উপেক্ষা করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা অপব্যবহার করেন তিনি। ২০১৫ সালে কিশোরগঞ্জের প্রাকৃতিক হাওর বিদীর্ণ করে নির্মাণ করেন সড়ক। ২৯ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক এখন স্থানীয়দের মরণ ফাঁদ। প্রতিবছর বন্যায় ভেসে যাচ্ছে হাওরাঞ্চলের বাড়ি-ঘর,কৃষি জমি। স্বাভাবিক পানি নিঃসরণের নালাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়। হাওরের বুক চিড়ে প্রকৃতি ও পরিবেশবিরোধী এ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রাথমিক ব্যয় ছিলো ছিলো ৮৪৭ কোটি টাকা। কয়েক দফায় প্রকল্পের ব্যয় বাড়ানো হয়। প্রকল্পটি থেকে হামিদ পরিবার ও তার ঘনিষ্ঠরা হাতিয়ে নেন শত শত কোটি টাকা। লুটপাটের মজা পেয়ে বসে হামিদ ঘনিষ্ঠদের। এ কারণে পরবর্তীতে হাওরাঞ্চল জুড়ে উড়াল সেতু নির্মাণের সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের আরেকটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। শেখ হাসিনা উৎখাত নাহলে হয়তো সেটিও বাস্তবায়ন শুরু হয়ে যেতো বলে জানিয়েছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
কিশোরগঞ্জে রয়েছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, বাজিতপুরে জহিরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজসহ একাধিক সরকারি-বেসরকারি মেডিকেল কলেজ। তা সত্ত্বেও আব্দুল হামিদ ২০১৩ সালে নিজ নামে ‘আব্দুল হামিদ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদ বিভিন্ন ব্যবসায়ী, মন্ত্রী-এমপির নিকট হতে চাঁদা সংগ্রহ করেন। চাঁদার টাকায় ডিবি হারুনকে দিয়ে পরবর্তীতে হাওরে নির্মাণ করেন বিলাসবহুল ‘প্রেসিডেন্ট রিসোর্ট’।
কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম এলাকায় আবদুল হামিদের নামের ওপর রাজত্ব করতেন ডিবি হারুন। চাঁদাবাজির জন্য ডিবি হারুনের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীল ছিলেন আব্দুল হামিদ। এ কারণে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে বহুল আলোচিত চাঁদাবাজি ও ব্যবসায়ী অপহরণের ঘটনায় দুইবার শাস্তির মুখোমুখি হয়েও পার পেয়ে যান হারুন।
আব্দুল হামিদের জোর তদবিরে হারুনকে পরবর্তীতে পুলিশের তেজগাঁও জোনের ডিসি ও পরে ডিএমপির ডিবি প্রধানের পদে বসানো হয়। সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের ছত্রছায়ায় ডিবি প্রধানের দায়িত্ব পেয়েই বেপরোয়া চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়েন হারুন। হারুনের চাঁদাবাজি ও লুটপাটের টাকায় কয়েকশ কোটি টাকা খরচ করে বড় ছেলে রেজওয়ান আহমেদ তৌফিককে কিশোরগঞ্জ-৪ আসনে এমপি করে আনেন আব্দুল হামিদ।
হারুনের টাকায় আবদুল হামিদ নিজের নামে নিকুঞ্জে ২ টি বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেন। পুত্র তৌফিকের নামে বেইলি রোডের রূপায়ণে কেনা হয় বিলাসবহুল ফ্ল্যাট। রাজধানীর বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে হামিদ পরিবারের। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়ও আব্দুল হামিদ পরিবারের রয়েছে আরেকটি ফ্ল্যাট।
তবে হাসিনা উৎখাতের পর কোথায় গেছেন আবদুল হামিদ, কোথায় আছেন হারুন- কেউ জানেন না। তবে ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ফ্ল্যাটে ৫ আগষ্ট থেকে আবদুল হামিদ, ডিবি’র হারুন কিছুদিন অবস্থান করেন বলে জানিয়েছে একটি সূত্র। গ্রামের বাড়িতেও দেখা যায়নি তাকে। কিশোরগঞ্জের হাওরে নির্মিত প্রাসাদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় বিক্ষুব্ধ জনতারা।
প্রেসিডেন্ট বড় ভাই এই প্রভাব কাজে লাগিয়ে কোটি কোটি টাকার মালিক হন হামিদের ছোট ভাই আব্দুল হক নূরু। এছাড়া বড় ছেলে তৌফিক, মেজো ছেলে তুহিন, সাবেক সচিব সম্পদ বড়ুয়া, প্রেস সচিব জয়নাল আবেদিন, উপ-সচিব জান্নাতুন নাঈমসহ অনেকেই হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা। এই অপকর্ম ও লুটপাট অব্যাহত রাখতে সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদকে দিয়ে একাধিকবার নিজেদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ বাড়িয়ে নেন সচিব সম্পদ বড়ুয়া ও প্রেস সেক্রেটারি জয়নাল আবেদীন। প্রেস সচিবের দায়িত্ব পালনকালে বঙ্গভবন এবং সংবাদকর্মীদের মধ্যে সুকৌশলে দূরত্ব সৃষ্টি করেন জয়নাল আবেদীন।
২০২৩ সালে মোহাম্মদ সাহাবুদ্দিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেয়ার পরও চুক্তির মেয়াদ আরেক দফা বাড়িয়ে নেন চতুর দুই কর্মকর্তা সম্পদ বড়ুয়া ও জয়নাল আবেদীন। গত ৫ আগষ্ট গণঅভ্যুত্থানের পর সম্পদ বড়ুয়ার চুক্তিভিত্তিক নিযোগ বাতিল হয়। কিছুদিন পর বাতিল হয় কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা প্রেস সচিব জয়নাল আবেদীনের নিয়োগও। বঙ্গভবনে বসে জয়নাল আবেদীন উৎখাত হওয়া ফ্যাসিস্টদের পুনর্বাসনে কলকাঠি নাড়তেন বলে জানা যায়।
সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুল হামিদের বিভিন্ন প্রকল্পের নামে লুটপাট, অবৈধ সম্পদ অর্জন এবং হাসিনার দোসরদের পুনর্বাসনের অভিযোগ সম্পর্কে জানতে কল করা হয় জয়নুল আবেদীনকে। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি। এসএমএস পাঠালেও মেলেনি কোনো সাড়া। তবে বিষয়গুলো নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)সহ কয়েকটি সংস্থা তদন্ত করছে বলে জানা গিয়েছে।
এম.কে
২৬ ডিসেম্বর ২০২৪