স্বৈরাচারী হাসিনার আমলে পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের নামে বছরে দেড় হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন আওয়ামী লীগ নেতা শাজাহান খান ও তার দোসররা। চাঁদাবাজির টাকায় ঢাকায় নির্মাণ করেছেন একাধিক বাড়ি ও ফ্ল্যাট। এমনকি শ্রমিক নেতা হয়ে পরিবহন ব্যবসাও শুরু করেন তিনি। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী রাজধানীর তোপখানা রোডে শাজাহান খান ও আরেক শ্রমিক নেতা ওসমানের মালিকানাধীন বহুতলবিশিষ্ট একটি ভবনের সন্ধান পাওয়া গেছে। হাসিনা পালিয়ে যাওয়ার পর এ ভবনের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর শ্রমিক সংগঠনগুলোর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেন শাজাহান খান। নির্বাচন ছাড়াই হাসিনা স্টাইলে শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি হন তিনি। আর সাধারণ সম্পাদক ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে বসান যথাক্রমে ওসমান আলী ও মোকলেছুর রহমানকে। এ দু’জনের মাধ্যমে শ্রম আইন এবং সড়ক পরিবহন আইনকে পাশ কাটিয়ে বিশেষ একটি নির্দেশিকা জারির মাধ্যমে ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে শ্রমিক সংগঠনের কল্যাণ ও পরিচালন ব্যয় বাবদ ৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা শুরু করেন শাজাহান খান।
চাঁদা আদায়ের জন্য সারা দেশে ২৪৯টি বেসিক ইউনিয়ন তৈরি করে শ্রমিক ফেডারেশন। তারা মূলত জেলা শ্রমিক ইউনিয়নের নামে বিভিন্ন সড়কে এ চাঁদা তুলতো। ২০২০ সালের ১০ সেপ্টেম্বর থেকে গত ৩১ জুলাই পর্যন্ত ১ হাজার ৪২১ দিনে প্রতিটি যান থেকে ৫০ টাকা করে মোট ৬ হাজার ৯৪ কোটি টাকার চাঁদা তোলা হয়েছে। বার্ষিক হিসাবে এ অংক দাঁড়ায় দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।
শ্রমিক সংগঠনের পরিচালন ব্যয় বাবদ আদায় করা চাঁদাবাজির অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ তুলে শাজাহান খানের বিরুদ্ধে পুলিশ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অভিযোগ দিয়েছে বেশ কয়েকটি শ্রমিক সংগঠন। এর অন্যতম ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়ন। সংগঠনটির দাবি, সারা দেশে সিএনজি, এলপিজি, পেট্রোলচালিত চার স্ট্রোক ইঞ্জিনের অটোরিকশা আছে ৩ লাখ ২৪ হাজার ৪১৩টি। এসব অটোরিকশা থেকে শ্রমিক সংগঠনের পরিচালন ব্যয় বাবদ ৫০ টাকা করে চাঁদা তোলা হয়। প্রতিদিন শুধু এ অটোরিকশা থেকেই চাঁদা আদায় হয় ১ কোটি ৬২ লাখ ২০ হাজার ৬৫০ টাকা। একইভাবে ১ লাখ ৬ হাজার ৫৫টি অটোটেম্পো, ৫৫ হাজার ২৮৩টি বাস, ৯ হাজার ৫৪৪টি কার্গো ভ্যান, ৪৮ হাজার ৩৫৮টি কাভার্ড ভ্যান, ১৭ হাজার ৩৮৩টি হিউম্যান হলার থেকে ৫০ টাকা হারে দৈনিক চাঁদা আদায় করা হয়। এর বাইরে ২৮ হাজার ৩৬৯টি মিনিবাস, ১ লাখ ৬৩ হাজার ৭২টি পিকআপ, ৭ হাজার ৩০টি ট্যাংকার, ৩৬ হাজার ১১১টি ট্যাক্সিক্যাব এবং ১ লাখ ৫২ হাজার ১৩১টি ট্রাক থেকে একই হারে প্রতিদিন চাঁদা তোলা হতো।
যদিও সড়ক পরিবহন আইনে এভাবে চাঁদা তোলার ওপর স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইনের ৩৮ ধারার ৩ উপধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে নির্ধারিত টার্মিনাল চার্জ ছাড়া কোথাও কোনো টার্মিনালে পরিবহন যান বা মোটরযান প্রবেশ বা বের হওয়ার সময় অথবা সড়ক, মহাসড়ক ও পাবলিক প্লেসে চলাচলের সময় যানবাহন থেকে কোনো ধরনের অর্থ অবৈধভাবে আদায় করা যাবে না।
ঢাকা অটোরিকশা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, নিয়মবহির্ভূতভাবে শাজাহান খান তার সহযোগীদের মাধ্যমে আদেশ জারি করে দেশজুড়ে চাঁদাবাজি করেছেন। চাঁদার টাকা সংগঠনের কল্যাণে বা পরিচালন ব্যয়ে খরচ না করে সেটা তিনি নিজে এবং রাজনীতিক, পুলিশ ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছেন। আমরা একাধিকবার বিষয়টি নিয়ে সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী (ওবায়দুল কাদের) এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (আসাদুজ্জামান খান কামাল) সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা কোনো প্রতিকার দেননি। কারণ তারাও সড়কে চাঁদাবাজির বড় একটি অংশ নিয়মিত পেয়েছেন। এ কারণেই তারা আমাদের অভিযোগ আমলে নেয়নি।
শ্রমিক সংগঠনগুলোর হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীর গাবতলী টার্মিনাল ব্যবহার করে ১২০টি কাউন্টারের মাধ্যমে ৩৭ জেলায় প্রায় ৯০০ বাস চলাচল করে। এর বাইরে ঢাকা-পাটুরিয়া রুটে সেলফি পরিবহন নামে একটি সার্ভিসের কয়েকশ’ বাস চলে। গাবতলী থেকে সাটুরিয়া-ঘিওর-মানিকগঞ্জ রুটের যানবাহন মালিকদের রয়েছে বাস-ট্রাক ওনার্স গ্রুপ। তাদেরও রয়েছে তিন শতাধিক বাস। ঢাকা-নবীনগর রুটেও আছে আলাদা কমিটি। এছাড়া ঢাকার অভ্যন্তরীণ রুটেও গাবতলী থেকে কিছু বাস চলে। প্রতিটি বাসকেই নির্ধারিত হারে চাঁদা দিতে হয়। এছাড়া গাবতলীর অদূরে মিরপুর ১ নম্বর শাহ আলী মাজারের সামনে প্রতি রাতে দুই শতাধিক সবজির ট্রাক আসে। সেখান থেকেও চাঁদা তোলা হয়। ক্ষেত্রভেদে প্রতিটি গাড়িকে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত চাঁদা দিতে হতো। এমনকি যেসব বাস টার্মিনাল ব্যবহার করত না, সেগুলোকেও চাঁদা দিতে হতো বলে পরিবহন মালিকরা জানিয়েছেন।
ভুক্তভোগীরা জানান, শুধু গাবতলী টার্মিনালকে কেন্দ্র করেই বিভিন্ন খাতে প্রতি মাসে কোটি কোটি টাকার চাঁদা উঠেছে। ৫ আগস্টের পর চিহ্নিত চাঁদাবাজদের অনেকেই পালিয়েছেন।
জানা গেছে, ঢাকা জেলা বাস, মিনিবাস ও কোচ শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি হাজী মোহাম্মাদ আলী সুবা, সহ-সভাপতি জলিলুর রহমানের মাধ্যমে সায়েদাবাদ টার্মিনালের নিয়ন্ত্রণ গড়ে তুলেছিলেন শাজাহান খান। এর বাইরে মিরপুর অঞ্চলের বাস, মিনিবাস থেকে চাঁদা আদায় করতেন ঢাকা মহানগর জাতীয় শ্রমিক লীগ উত্তরের বর্তমানে পলাতক সাধারণ সম্পাদক কালু শেখ। কালু শেখ ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এপিএস হাফিজুর রহমান লিকুর ঘনিষ্ঠ সহচর। হাফিজুর রহমান লিকুও এ চাঁদার টাকার ভাগ পেতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ জানায়, বর্তমান সরকারের আমলে সব ধরনের চাঁদা বন্ধ করা হয়েছে। কোনো কোনো স্থান বিচ্ছিন্নভাবে কেউ চাঁদাবাজি করলে পুলিশকে জানাতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এম.কে
৩১ জানুয়ারি ২০২৪