দীর্ঘ ১৪ বছর পর ব্রিটেনের শাসনক্ষমতায় আসছে লেবার পার্টি। দেশটির সাধারণ নির্বাচনে দলটি এবার ৪১২টি আসন পেয়েছে, যা গত ২৫ বছরের মধ্যে দলটির সবচেয়ে বড় জয়। স্যার কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বে দলটি গত ২০১৯ সালের নির্বাচনের চেয়ে এবার মাত্র দুই পয়েন্ট বেশি ভোট পেয়েছে। আর তাতেই লেবার পার্টির আসন সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এর অন্যতম কারণ হলো কনজারভেটিভদের সমর্থন হ্রাস।
কনজারভেটিভদের দুর্বলতা ছাড়াও আরও বেশ কিছু বিষয় লেবারদের বিজয়ে ভূমিকা রেখেছে। রিফর্ম ইউকে পার্টি কনজারভেটিভ বা টরি ভোটের বড় অংশ টেনেছে। লিবারেল ডেমোক্র্যাট পার্টিও প্রত্যাশার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছে। এসব বিষয়ে নিয়ে বিস্তর একটি প্রতিবেদন করেছে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
এবারের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি যুক্তরাজ্যের ১৭০ অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। হাউস অব কমন্স লাইব্রেরির তথ্য বলছে, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের প্রথম মেয়াদের পর এটিই সবচেয়ে বড় জয়। ১৯৯৭ সালে তার নেতৃত্বে লেবার পার্টি ১৭৮ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। সেবার টনি ব্লেয়ার সংসদীয় আসনের ৬৩ দশমিক ৪ দখল করেছিলেন। এটি আধুনিক যুগে যেকোনো সরকারের সর্বোচ্চ জয়। এর আগে ক্লিমেন্ট অ্যাটলি ১৯৪৫ সালে ১৪৭ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিলেন।
কনজারভেটিভদের সমর্থন কমে যাওয়ায় এবারের নির্বাচনে দলটির ভরাডুবি হয়েছে। বিশেষ করে পূর্ব ইংল্যান্ড, মিডল্যান্ডস এবং ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিমে তাদের তরী মাঝ নদীতেই ডুবেছে।
ওয়েলসে কনজারভেটিভ পার্টির সমর্থন ১৯১৮ সালের পর থেকে সর্বনিম্ন স্তরে নেমে এসেছে। মাত্র ১৮ শতাংশ ওয়েলশ ভোটাররা দলটিকে ভোট দিয়েছেন। তবে টরি শিবিরে ভরাডুবির সুফল পুরোটা ঘরে তুলতে পারেনি লেবাররা। ২০১৯ সালের নির্বাচনে পশ্চিম মিডল্যান্ডস এবং দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডে লেবাররা যেই ভোট পেয়েছিল এবারও তার আশপাশেই ঘুরপাক খেয়েছে দলটি এবং লন্ডনে ভোট কমে গেছে দলটির।
উল্টো তৃতীয় পক্ষগুলো কনজারভেটিভদের ভোট টেনেছে নিজেদের ঝুলিতে। তবে এর ব্যতিক্রম দেখা গেছে স্কটল্যান্ডে। সেখানে স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টির (এসএনপি) ব্যাপক ভরাডুবির মধ্যে লেবার পার্টির ভোট বেড়েছে।
কনজারভেটিভদের কম ভোট পাওয়া ও লেবার পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পেছনে প্রধান কারণ ছিল নাইজেল ফারাজের রিফর্ম ইউকে পার্টি। দলটি মাত্র চারটি আসন পেলেও ১০৩টি আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। এর মধ্যে ১২টিতে পরাজয়ের ব্যবধান ছিল মাত্র পাঁচ হাজার ভোট। পূর্ববর্তী যেকোনো নির্বাচনের চেয়ে ফারাজের পার্টির সবচেয়ে বড় চমক এটি।
ব্রেক্সিট পার্টিটি ২০১৯ সালে মাত্র তিনটি আসনে দ্বিতীয় স্থান দখল করতে পেরেছিল। যদিও সেবার দলটি কনজারভেটিভের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি। ফারাজের ইউকে ইনডিপিন্ডেন্স পার্টি ২০১৫ সালে মাত্র একটি আসন জিতেছিল। তবে সেবার দলটি ১২০টি আসনে দ্বিতীয় হয়েছিল।
ডানপন্থী ভোটারদের মধ্যে বিভক্তির আশঙ্কা আগে থেকেই করা হচ্ছিল। সেই বিভাজনের কারণেই ১৮০টি আসনে মূল্য চোকাতে হয়েছে কনজারভেটিভদের। অন্য কথায়, এই আসনগুলোতে সেসব ভোট রিফর্ম পার্টি পেয়েছে সেগুলো যদি কনজারভেটিভ পার্টি পেত তবে তারা জয়ী হতে পারত। বিজয়ী না হলেও পূর্বে ইংল্যান্ডের আরও ২৫টি আসন কনজারভেটিভ পার্টি পেত।
পশ্চিম মিডল্যান্ডস, পূর্ব মিডল্যান্ডস, দক্ষিণ-পূর্ব, দক্ষিণ-পশ্চিম এবং ওয়েলসের এক তৃতীয়াংশেরও বেশি আসনের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা ছিল। রিফর্ম পার্টি ও কনজারভেটিভদের ভোট এক করলে ফলাফলে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন দেখা দিত ক্যানক চেজ জেলায়। সেখানে রিফর্ম ইউকে ২৬ দশমিক ৯ শতাংশ ও কনজারভেটিভ পার্টি ২৯ দশমিক ২১ শতাংশ ভোট পেয়েছে। দল দুটির ভোট এক করলে সহজেই লেবারের ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ ভোটকে ছাড়িয়ে যায়।
লেবারদের বিজয়ের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ছিল উত্তর ইংল্যান্ড। এই এলাকাকে লেবার পার্টির হার্টল্যান্ড বলা হয়ে থাকে। এ ছাড়া মধ্য ইংল্যান্ডের আসনগুলোতেও জয় পেয়েছে।
দ্য গার্ডিয়ান ৩৩টি নতুন নির্বাচনী এলাকা চিহ্নিত করেছে, যা ২০১৯ সালের নির্বাচনের ‘লাল প্রাচীর’ এলাকায় পড়ে। লেবার পার্টি এসব আসনের মধ্যে ২৫টি পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছে। ‘লাল প্রাচীর’ এলাকার মূল আসনগুলো ফিরে পাওয়া লেবার পার্টির কৌশলবিদদের খুশি করবে। তারা ২০১৭ এবং ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে দল থেকে দূরে সরে যাওয়া শ্রমিক শ্রেণি এবং ব্রেক্সিট-ভোটারদের সঙ্গে পুনরায় সংযোগ স্থাপনের আশা করেছিল।
এই জয়ের কিছু অবশ্য কনজারভেটিভ পার্টির ভোট হ্রাস দিয়ে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। লেবার ২০১৯ সালের তুলনায় কম ভোট পেয়ে এই আসনগুলোর মধ্যে ছয়টিতে জিতেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল বার্নলি, হাইন্ডবার্ন এবং বোল্টন নর্থ ইস্ট। এই তিন আসনে লেবার পার্টির ভোট পাঁচ পয়েন্টের বেশি কমে যাওয়া সত্ত্বেও ফলাফল উল্টে গেছে।
গোটা ইংল্যান্ডেই কনজারভেটিভদের সমর্থন তলানিতে নামায় এবার তাদের পতন অনেকটা পূর্বনির্ধারিত ছিল। তবে যেসব আসনে তারা সবচেয়ে বড় ব্যবধানে হেরেছে সেসব আসনের ভোটাররা ঋষি সুনাকের দলকে প্রত্যাখ্যান করেছিল বলে জানতে পেরেছে গার্ডিয়ানের একটি সূত্র।
গার্ডিয়ানের নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০১৬ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়তে বা ব্রেক্সিটে যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি লোক ভোট দিয়েছিল, সেসব এলাকাতেই কনজারভেটিভ পার্টি গো-হারা হেরেছে। ২০১৭ এবং ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে রক্ষণশীল সমর্থনের সঙ্গে ২০১৬ সালের ব্রেক্সিট ভোটারদের একটি সম্পর্ক ছিল। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনে সেটি উবে গেল। এটি কনজারভেটিভ পার্টির জন্য উদ্বেগজনক কারণ—যেসব ভোটারদের ওপর নির্ভর করে আগেরবার দলটি ক্ষমতায় এসেছিল পরেরবারই তারা মুখ ফিরিয়ে নিল।
যুক্তরাজ্যের এই নির্বাচন লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের জন্য এক শুভদিন। দলটি কত আসন পেতে পারে তা নিয়ে আগে থেকেই নানা জল্পনা-কল্পনা ছিল। কনজারভেটিভ ও লিব ডেম—উভয়েরই লক্ষ্য ছিল দক্ষিণ-পশ্চিমে নিজেদের আসন পুনরুদ্ধার করা এবং ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বের ঐতিহ্যগত রক্ষণশীল এলাকায় জয়লাভ করা।
তবে লিবারেল ডেমোক্রেট পার্টি এবার কনজারভেটিভদের ৬০ আসন ছিনিয়ে নিতে পারবে সেটি দলটির নেতা এড ডেভিও কল্পনা করেননি। লিব ডেমস শেষ পর্যন্ত মোট ৭১টি আসন জিতেছে। দলটি মূলত দক্ষিণ ইংল্যান্ডের আসনগুলোতে জয়ী হয়েছে।
এ ছাড়া দলটি নর্থ শ্রপশায়ার, হোনিটন এবং সিডমাউথ এবং চিচেস্টারের মতো আসনেও জয় পেয়েছে। এসব আসনের সবকটিতেই ২০১৯ সালে কনজারভেটিভ পার্টি জিতেছিল। এসব আসনে লিবারেল ডেমোক্র্যাটরা ২৫ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে।
যুক্তরাজ্যের কিছু আসন রয়েছে যেগুলোতে বরাবরই কনজারভেটিভ পার্টি জয়লাভ করে। এসব আসন দেশটির মিডল্যান্ডে। তবে এবারের নির্বাচনে সেসব রেকর্ড ভেঙে গেছে। ২০২৪ সালের আগে সর্বশেষ ১৯৯৭ সালে ব্রেন্ট নর্থে ১৮ দশমিক ৮ শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে এখানে কনজারভেটিভদের হারিয়েছিল লেবার পার্টি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের ইতিহাসে এটিই ছিল সবচেয়ে বড় চমক।
সেই রেকর্ডটি এবার রাতারাতি ভেঙে গেছে। সর্বশেষ সাধারণ নির্বাচনে মিডল্যান্ডের ৪৬টি আসনে জয় পেয়েছে লেবার পার্টি। সবচেয়ে বড় কনজারভেটিভ-টু-লেবার ক্ষমতার পালাবদল হয়েছে যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ পশ্চিম নরফোকে। এই এলাকায় ২৫ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে লেবার পার্টি। এতে কনজারভেটিভরা এমন সব আসন হারিয়েছে, যা তারা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোনো নির্বাচনে হারায়নি। যেমন—অ্যাল্ডারশট, অল্টরিংহাম, চিচেস্টার, ডোরকিং এবং টুনব্রিজ ওয়েলস।
আনাস সারওয়ার খুশি হবেন যে লেবার পার্টির স্কটিশ শাখা আবারও স্কটল্যান্ডে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। স্কটল্যান্ডের ৫৭টি আসনের মধ্যে ৩৭টি জিতেছে লেবার পার্টি। বিপরীতে এসএনপি পেয়েছে মাত্র নয়টি।
২০১০ সালের সাধারণ নির্বাচনে লেবার পার্টি ৫৯টি আসনের মধ্যে ৪১টি আসন জিতেছিল, কিন্তু ২০১৫ সালে প্রায় সব আসন হারিয়ে একটিতে জয় দলে রাখতে পেরেছিল। ২০১০ সালের পর লেবার পার্টি স্কটল্যান্ডে ১০ টির বেশি আসন পেতে হিমশিম খেয়েছে।
এবার এয়ারড্রি, শটস, আল্লোয়া, গ্র্যানগেমোথ এবং লোথিয়ান ইস্টের মতো আসনে জয় তুলে নিয়ে লেবার পার্টি স্কটল্যান্ডে নিজের শক্তির জানান দিয়েছে।
এবার নির্বাচনী প্রচারণার সময় ভোটারদের উদাসীনতার লক্ষ্য করা হয় এবং এর ফলাফল ভোটহারে দেখা গেছে। গত সাধারণ নির্বাচনে ভোটদানের হার ৬৭ শতাংশ থেকে কমে ৬০ শতাংশ হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। ম্যানচেস্টার রুশোলমে, লিডস সাউথ এবং কিংস্টন অন হাল ইস্টসহ ৫৯টি নির্বাচনী এলাকায় অর্ধেকেরও কম ভোটার উপস্থিতি ছিল।
নির্বাচনের আগে গ্রিন পার্টি বলেছিল, দলটি এবারের নির্বাচনে চারটি আসন জয় পাবে। আসনগুলো হলো—ব্রাইটন প্যাভিলিয়ন, ব্রিস্টল সেন্ট্রাল, ওয়েভেনি ভ্যালি এবং নর্থ হেয়ারফোর্ডশায়ার। যেমন কথা তেমন কাজ। দলটি নির্বাচনের ফলাফলেও দেখিয়েছে তাই।
শেষ পর্যন্ত কার্লা ডেনিয়ার এবং অ্যাড্রিয়ান রামসের দল ঘোষিত সবগুলো আসনে জয় পেয়েছে। পার্টির আসনসংখ্যা চারগুণ করেছে এবং উত্তর হেয়ারফোর্ডশায়ারে দলটি ভোটের হার ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৪৩ দশমিক ২ শতাংশ করেছে।
একই সঙ্গে গ্রিনস ভোটপ্রাপ্তির হার ২০১৯ সালের ২ দশমিক ৭ শতাংশ থেকে ২০২৪ সালে ৭ শতাংশে উন্নীত করতে সক্ষম হয়েছে। দলটি এবার ৪৭টি আসনে দ্বিতীয় হয়েছে, যা পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের জন্য বড় শক্তি।
২৬ জন সিনিয়র কনজারভেটিভ এমপি এই নির্বাচনে হেরেছেন, যার মধ্যে কেউ কেউ ৪০ শতাংশ ভোটে হেরেছেন। নির্বাচনের আগে চেলটেনহ্যামে ক্যাবিনেট মন্ত্রী ও বিচার সচিব অ্যালেক্স চাক ও গডালমিং অ্যান্ড অ্যাশে চ্যান্সেলর জেরেমি হান্টের মতো প্রার্থিরা ‘পোর্টিলো মোমেন্টস’ এর সম্ভাব্য শিকার হবেন বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কারণ তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অপেক্ষাকৃত কম ছিল।
হান্ট আসন ধরে রাখতে সক্ষম হলেও সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস লেবার প্রার্থী টেরি জার্মির বিরুদ্ধে আশ্চর্যজনকভাবে পরাজিত হয়েছেন।
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
০৬ জুলাই ২০২৪