ভারতের কয়েকটি মিডিয়ায় বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কল্পকাহিনি শুনতে শুনতে কান যখন ঝালাপালা, তখন মনে হলো জেলা শহর থেকে সর্ব উত্তরে পাশাপাশি গা ঘেঁষে শতবছরের ঐতিহ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হিন্দু অধ্যুষিত ৩৬ গ্রামের মানুষের খোঁজ নিয়ে আসি। কেমন আছেন তারা। বর্তমান পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে তারা কতটুকু নিরাপত্তা বোধ করছেন।
এ বিষয়ে আমার দেশ পত্রিকায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য ২১ ডিসেম্বর বিকালে এক সহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে মোটরসাইকেলযোগে রওনা হই ৩৬ গ্রামের মধ্যে অন্যতম প্রসিদ্ধ গ্রাম ভীমরুলীর উদ্দেশে।
সরু সড়ক দিয়ে চলতে থাকে মোটরসাইকেল। সড়কের এক পাশে খাল ও দুই পাশে সারি সারি গাছ। পড়ন্ত বিকালে সে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। পথিমধ্যে চা খেতে যাত্রা বিরতি দেই একটি চায়ের দোকানে। দোকানটি কৃত্তীপাশা ইউনিয়নের খাজুরা গ্রামের শিব মন্দির সংলগ্ন। দোকানের নাম সঞ্জয় স্টোর, মালিক সঞ্জয় হালদার। চা খেতে খেতে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘দাদা ৫ আগস্টের পরে আপনারা কেমন আছেন? সময়ক্ষেপণ না করেই সোজাসাপ্টা উত্তর, ভালো আছি দাদা। যে কোনো সময়ের চেয়ে ভালো ও নিরাপদে আছি।’ এবার দুর্গাপূজা কেমন হলো জানতে চাইলে সনজয় জানান, আমার গ্রামসহ আমাদের পার্শ্ববর্তী ৩৬ গ্রামেই শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
চা খেয়ে গেলাম দোকানের সামনেই ঐতিহ্যবাহী শিব মন্দিরে। মন্দির কমিটির সাধারণ সম্পাদক সাগর মিত্র আমার দেশকে বলেন, ৫ আগস্টের পরে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ৩৬ গ্রামের কোথাও কোনো লুটতারাজ বা দাঙ্গা-হাঙ্গামার ঘটনা ঘটেনি। তারা নিরাপদেই ধর্মীয় কর্মসূচিগুলো পালন করে যাচ্ছেন। তবে ভারতের মিডিয়ার খবরে প্রথম প্রথম তারা ভয় পেতেন, এখন সে ভয় আর নেই।
সাগর মিত্রর সঙ্গে কথা বলে আবারও মোটরসাইকেল স্টার্ট করে রওনা হই ভীমরুলীর দিকে। ওখান থেকে তিন থেকে চার কিলোমিটার পথ চলার পরেই ভীমরুলী হাটে গিয়ে নামি। এখানে রয়েছে দেশের বিখ্যাত অন্যতম ভাসমান হাট। এটি ছোটখাটো একটি পর্যটন স্পটও বলা চলে।
ভীমরুলীতে রয়েছে বড় ধরনের একটি মন্দির। ঝালকাঠির মধ্যে এই মন্দিরে সবচেয়ে বড় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়। মন্দিরে কথা হয় মন্দির কমিটির নেতা এবং এই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ভবেন হালদারের সঙ্গে।
তিনি আমার দেশকে বলেন, আমরা এখানে শান্তিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছি। আমাদের ব্যবসায়ীরা এখানে কোনো ধরনের চাঁদাবাজি ছাড়াই ব্যবসা করছে। ভীমরুলীসহ আশপাশের গ্রামে কোনো সাম্প্রদায়িক থ্রেট নেই।
ভীমরুলী বাজারে আমাদের অবস্থানের সময় সাংবাদিক দেখে অনেকেই এসে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন, তারা ভারতীয় মিডিয়ার অতিরঞ্জিত খবরকে এ দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের উসকানি মনে করেন। এ ধরনের প্রচারণা বন্ধেরও দাবি জানান তারা।
কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। ভীমরুলী বাজারের পাশেই রয়েছে সনাতনী সম্প্রদায় অধ্যুষিত একটি বড় বাড়ি। মাঝেরবাড়ী নামে পরিচিত এ বাড়িতে রয়েছে ২৫-২৬টি ঘর। ঘরগুলো দেখে মনে হলো এখানে সবাই সম্ভ্রান্ত পরিবারের।
বিকালে এ বাড়ির আঙিনায় দেখা যায় ছোট বাচ্চারা খেলাধুলা করছে। যখনই দেশে কোনো পটপরিবর্তন হয়, তখনই আতঙ্কে থাকেন এ বাড়ির বাসিন্দারা। এমনকি ইউপি নির্বাচনের ফলাফলের পরও তারা আতঙ্কে থাকেন। তবে এবারে প্রেক্ষাপট ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তারা মনে করেছিলেন, যেহেতু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে, তাই আওয়ামী লীগের ভোটার মনে করে তাদের ওপর হামলা হতে পারে। কিন্তু তাদের সে আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এ বাড়িতে আমার দেশের প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় বয়োজ্যেষ্ঠ কয়েকজন নাগরিকের সঙ্গে।
তারা জানান, প্রথমে আমরা ভয় পেয়েছিলাম, তবে কিছুই হয়নি। এখন আমরা নিরাপদে ও ভালো আছি। তারা বিভিন্ন বিদেশি মিডিয়ায় হিন্দু নির্যাতনের মিথ্যা কাহিনি প্রচারে বিস্ময় প্রকাশ করেন।
মাঝেরবাড়ী থেকে বিদায় নিয়ে সোজা ঝালকাঠি শহরে চলে আসলাম। চিন্তা করলাম এবার পুরো জেলার পরিস্থিতি জানা দরকার। ফোনে কন্ট্যাক্ট করে শহরের ফায়ার সার্ভিস মোড়ে আখড়াবাড়ী মন্দিরে গেলাম। কথা বললাম, বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ, ঝালকাঠি জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট নির্মল চন্দ্র দে তরনীর সঙ্গে।
তিনি আমার দেশকে জানালেন, এবারে দুর্গাপূজা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে হয়েছে জেলার কোথাও কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। জেলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট হয় এমন ঘটনাও ঘটেনি। যে কোনো সময়ের চেয়ে আমরা ভালো আছি।
সম্প্রতি দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভারতীয় মিডিয়ার খবরের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে হিন্দু সম্প্রদায়ের এ নেতা আমার দেশকে বলেন, যেসব মিডিয়া হিন্দু নির্যাতনের অতিরঞ্জিত খবর প্রকাশ করছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।
উল্লেখ্য গত ৫ আগস্টের পর হতে ঝালকাঠি জেলায় এ পর্যন্ত কোনো সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। মূলত রাজনৈতিক ও জমিজমা নিয়ে বিরোধের কারণে বিচ্ছিন্ন দুই-তিনটি ঘটনা ঘটেছে, সে বিষয়ে এরই মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সূত্রঃ আমার দেশ
এম.কে
০৫ জানুয়ারি ২০২৫