ভ্যাটিকানের যাত্রা ১৯২৯ সাল থেকে শুরু হয়। সেই সময় ঐতিহাসিক ল্যাত্রান চুক্তির মাধ্যমে ভ্যাটিকান সিটি রাষ্ট্রটি ইতালির মূল ভূখণ্ডের ভেতরেই স্বাধীন এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। ইতালির রাজ্য ও পোপের নেতৃত্বে ক্যাথলিক চার্চের মধ্যে চুক্তিটি সই হয়। সেই বছর ১১ ফেব্রুয়ারি ইতালির রাজপক্ষে সই করেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেনিতো মুসোলিনি এবং পোপ পিয়াস-১১-এর পক্ষে কার্ডিনাল পিয়েত্রো গাস্পার্রি। তবে ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত ভ্যাটিকানের ৮৬ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো পোপ সরাসরি ও আনুষ্ঠানিকভাবে একটি দখলকৃত ভূখণ্ডকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন। যা পশ্চিমা বিশ্ব ভালোভাবে মেনে নিতে পারেনি।
এটি ছিল পোপ ফ্রান্সিসের ব্যতিক্রমী, সাহসী ও নীতিগত পদক্ষেপ। সেই সময় অনেক দেশ যেখানে রাজনৈতিক ভারসাম্যের কারণে দোটানায় ছিল, সেখানে পোপ ফ্রান্সিস শুধু মানবিক বিবেচনায় ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান নেন।
মানবিকতা ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতি তার গভীর দায়বদ্ধতা বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট হতে থাকে ২০১৩ সালে পোপ হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই। তিনি তার পুরো পোপত্ব কালীন সময়জুড়েই দরিদ্র, নিপীড়িত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর পক্ষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছেন।
তিনি মনে করেন, বিশ্ব রাজনীতি একপেশে ও সুবিধাবাদী। ফিলিস্তিনিদের প্রতি আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার অব্যাহতভাবে অবহেলিত। ধর্মীয় সহনশীলতা ও অভিন্ন আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করতেন পোপ ফ্রান্সিস। তিনি মনে করেন, মুসলিম-খ্রিস্টান-ইহুদি সবাই আদমের সন্তান এবং অভিন্ন ঐতিহ্য বহন করে। তাই ফিলিস্তিনের মুসলিমদের ধর্মীয় অধিকার, পবিত্র স্থানে স্বাধীনভাবে প্রবেশাধিকার ও বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত করা উচিত।
ফিলিস্তিনে ক্যাথলিকদের নিরাপত্তা ও উপস্থিতিঃ ভ্যাটিকান চায়, ফিলিস্তিনে বসবাসরত খ্রিস্টান সম্প্রদায় শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মীয় জীবনযাপন করুক। এই স্বীকৃতি সেই নিরাপত্তার প্রতীকও বটে। ফিলিস্তিনকে আনুষ্ঠানিকভাবে পোপ ফ্রান্সিসের স্বীকৃতি ছিল তার একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বার্তা, যা ফিলিস্তিনবাসীর স্বাধীনতার দাবিকে আন্তর্জাতিক মহলে জোরদার করে।
২০১৪ সালে পোপ ফ্রান্সিস তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ফিলিস্তিন গিয়ে দেশটিকে স্বীকৃতি দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। সে আশ্বাসের ভিত্তিতেই দেশটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য প্রক্রিয়া শুরু করে ভ্যাটিকান। পরের বছর ১৩ মে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া বিষয়ে পোপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ভ্যাটিকান ফিলিস্তিনকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে দেখতে চায়।
দেশটির কর্মকর্তারা জানান, তারা ইসরায়েলের আগ্রাসনে হতাশ। ইসরায়েল আসলে শান্তি চায় না, তাই তারা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য নথিপত্র ঠিক করতে শুরু করেছে। খুব তাড়াতাড়ি তা সই করে আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে।
ফিলিস্তিন প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে ওই আলোচনায় পোপ বলেছিলেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের সম্পর্কোন্নয়নে ২০ বছর ধরে কাজ করছে ভ্যাটিকান।
মৃত্যুর একদিন আগেও ফিলিস্তিনবাসীর দাবির প্রতি সংহতি জানিয়ে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের তীব্র নিন্দা জানিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস।
রোববার (২০ এপ্রিল) খ্রিস্ট ধর্মীয় উৎসব ‘ইস্টার সানডে’ উপলক্ষে দেয়া ভাষণে গাজায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। ভ্যাটিকানের সেন্ট পিটার্স স্কয়ারে জড়ো হওয়া হাজারো ধর্মপ্রাণ মানুষের সামনে এ আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডে ইসরায়েলের ১৮ মাসব্যাপী হামলার ফলে সৃষ্ট শোচনীয় মানবিক বিপর্যয়ে নিন্দা জানান তিনি। সেই সঙ্গে, বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর প্রশাসনকে উদ্দেশ্য করে পোপ ফ্রান্সিস বলেছিলেন, ‘আমি যুদ্ধরত সব পক্ষের কাছে আবেদন করছি অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করুন, জিম্মিদের মুক্তি দিন এবং শান্তির প্রত্যাশী ক্ষুধার্ত মানুষের সাহায্যে এগিয়ে আসুন।’
শুধু ‘ইস্টার সানডে’র দিনেই নয়; আগেও ইসরায়েলি সামরিক আগ্রাসনের সমালোচনা করে গেছেন ফ্রান্সিস। গত জানুয়ারিতে তিনি গাজার পরিস্থিতিকে ‘অত্যন্ত গুরুতর এবং লজ্জাজনক’ বলে অভিহিত করেছিলেন। একই সঙ্গে অঞ্চলটিতে ইসরায়েলি ‘গণহত্যার’ তদন্ত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছিলেন।
ইসরায়েলি নির্মমতার বিরুদ্ধে, ফিলিস্তিনিদের পক্ষে পোপ ফ্রান্সিসের দৃঢ় অবস্থানঃ দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসজনিত জটিল রোগে ভুগছিলেন পোপ ফ্রান্সিস। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত পোপকে চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এর আগে ইতালির রোমে একটি বিশেষায়িত হাসপাতালে বেশ কিছুদিন চিকিৎসা চলে তার। ভ্যাটিকান সিটি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সোমবার (২১ এপ্রিল) ভ্যাটিকানে কাসা সান্তা মার্তায় নিজ বাসভবনে মারা যান ৮৮ বছর বয়সী পোপ। তবে পোপ ফ্রান্সিসের জীবনের শেষ দিকে তিনি দুটি অসম এবং অন্যায্য যুদ্ধ দেখে গেছেন। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের ওপর রুশ হামলা শুরুর প্রায় দেড় বছর পর বিশ্ববাসীকে দেখে যেতে হচ্ছে আরেকটি অন্যায্য যুদ্ধ-গাজা যুদ্ধ।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি বাহিনী এবং গাজার শাসকগোষ্ঠী হামাসের যুদ্ধ শুরু হলে পোপ ফ্রান্সিস একাধিকবার শিশু, নারী ও নিরীহ মানুষের ওপর ইহুদিবাদী দেশটির বোমা হামলার কড়া নিন্দা জানান।
তিনি বলেন, এই সংঘাতে যেন শিশু, অসুস্থ, বৃদ্ধ, নারীসহ সব শ্রেণি-পেশার বেসামরিক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। তিনি মানবিক করিডোর খোলার পক্ষে সরব ছিলেন, যাতে গাজার মানুষের কাছে খাদ্য, ওষুধ ও জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী পৌঁছানো যায়।
বিধ্বস্ত গাজায় যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান নয়, বরং এটি মানবতাবিরোধী বিপর্যয়ের উৎস।
গাজায় সংঘাতরত কোনো পক্ষের হয়ে কথা বলেননি তিনি। বরং বারবার জোর দিয়েছেন, ‘হিংসা হিংসাই জন্ম দেয়। যুদ্ধ কখনো শান্তি আনে না।’
ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে ও মধ্যপ্রাচ্য শান্তি প্রতিষ্ঠায় পোপ ফ্রান্সিস আন্তঃধর্ম সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি মুসলিম, ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতাদের প্রতি শান্তির আহ্বান জানিয়ে বলেন, আমরা আদমের সন্তান। চলো আমরা সবাই শান্তি প্রতিষ্ঠায় একসঙ্গে এগিয়ে যাই।
পোপ ফান্সিস হিসেবে দায়িত্বভার নেয়ার পরপরই ২০১৪ সালে ইসরায়েলি প্রেসিডেন্ট শিমন পেরেজ ও ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে ভ্যাটিকানে আমন্ত্রণ জানান আর্জেন্টিনার এই নাগরিক জর্জ মারিও। একসঙ্গে শান্তির জন্য প্রার্থনার আয়োজন করতে। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক উদ্যোগ, যেখানে ধর্ম ও মানবতার নামে শান্তির জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রার্থনা করা হয়।
পোপ বারবারই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, জাতিসংঘ, বিশ্বনেতা ও অন্যান্য শক্তিধর দেশের সরকার প্রধানকে আহ্বান জানিয়েছেন যাতে তারা নিপীড়িতদের পাশে দাঁড়ায় এবং যুদ্ধ থামাতে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
সংঘাত নিরসনে পোপ ফ্রান্সিস সরাসরি ধর্মের দোহাই দেননি বরং নৈতিক অবস্থান নিয়ে বারবার শান্তি, যুদ্ধবিরতি ও মানবিকতার পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।
তিনি ছিলেন অবিচল মানবতার কণ্ঠস্বর, যিনি বিশ্ব বিবেককে নাড়া দেয়ার চেষ্টা করেছেন। নিরীহ মানুষদের রক্ষা করতে এবং সহিংসতার স্থানে শান্তির আলো জ্বালাতে চেষ্টা চালিয়ে যান তিনি। ক্যাথলিক গির্জার বেশকিছু উদারনীতি ও সংস্কারের জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ক্যাথলিক খ্রিষ্টান, নন–ক্যাথলিক খ্রিষ্টানসহ অন্য ধর্মের মানুষের মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছেন পোপ ফ্রান্সিস।
ধর্মযাজকের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের এবং কানাডার আদিবাসীদের কাছে আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চেয়ে তিনি আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন।
এম.কে
২১ এপ্রিল ২০২৫