যুক্তরাজ্যের কেন্টের ম্যানস্টন মাইগ্র্যান্ট প্রসেসিং সেন্টারে ছোট নৌকায় করে আগত রেকর্ডসংখ্যক অভিবাসী সামাল দিতে কর্মীদের অতিরিক্ত সময় কাজ করতে বলা হয়েছে বলে সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান জানতে পেরেছে বলে এক প্রতিবেদনে জানা যায়।
শনিবার সন্ধ্যায় হঠাৎ করে একটি জরুরি অনুরোধ পাঠানো হয় কর্মীদের কাছে, যাতে তারা অতিরিক্ত সময় কাজ করতে সম্মত হন। র্যামসগেটের কাছে অবস্থিত এই সাইট পরিচালনার দায়িত্বে থাকা হোম অফিসের ঠিকাদার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং কর্পোরেশন (MTC) এ নির্দেশনা জারি করে। যথেষ্ট সংখ্যক কর্মী না থাকায় তাদের মধ্যে উদ্বেগ পরিলক্ষিত হয়েছে।
শনিবার চ্যানেল পার হয়ে ১,১০০ জনেরও বেশি অভিবাসী যুক্তরাজ্যে পৌঁছান — যা এ বছরের মধ্যে একদিনে সর্বোচ্চ। হোম অফিসের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ওই দিন ১৮টি ছোট নৌকায় মোট ১,১৯৪ জন পাড়ি জমান, ফলে এ বছরের মোট আগত অভিবাসীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪,৮১১ জন।
এই সংখ্যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪২% বেশি (২০২৪ সালে ছিল ১০,৪৪৮ জন) এবং ২০২৩ সালের তুলনায় ৯৫% বেশি (তখন ছিল ৭,৬১০ জন)।
একটি সূত্র জানায়, বিশেষ করে রাতের শিফটে কর্মী সংকট দীর্ঘদিন ধরেই চলছে ম্যানস্টনে। এই কেন্দ্রটি দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনার মুখে পড়েছে সেখানে আশ্রয়প্রার্থীদের অমানবিক ও নিরাপত্তাহীন অবস্থায় রাখা নিয়ে।
রবিবার স্কাই নিউজের ‘সানডে মর্নিং উইথ ট্রেভর ফিলিপস’ অনুষ্ঠানে প্রতিরক্ষামন্ত্রী জন হিলি বলেন, “সত্য হলো, গত পাঁচ বছরে ব্রিটেন সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে, আর গত বছরকার সরকার একটি বিশৃঙ্খল শরণার্থী ব্যবস্থা রেখে গেছে।”
তিনি বলেন, “এই মুহূর্তে বড় সমস্যা হলো, ফরাসি পুলিশ অগভীর পানিতে ছোট নৌকা থামাতে পারছে না। আমরা চাই, ফ্রান্স দ্রুত নতুন নীতিমালা কার্যকর করুক যাতে তারা হস্তক্ষেপ করতে পারে।”
এই রেকর্ডসংখ্যক পারাপারের খবর এসেছে এমন একটি রিপোর্টের পর, যেখানে দেখা গেছে—ছোট নৌকায় চ্যানেল পেরিয়ে আসার দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত শিশু-সহ শরণার্থীর সংখ্যা এক বছরে দ্বিগুণ হয়েছে।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্ডার ক্রিমিনোলজিস ও সেন্টার ফর ক্রিমিনোলজি প্রকাশিত “আই টোল্ড দেম দ্য ট্রুথ” শীর্ষক এই রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে—Humans for Rights Network, Captain Support UK ও Refugee Legal Support-এর মামলা সংক্রান্ত তথ্য, আদালত পর্যবেক্ষণ, এবং জেলবন্দিদের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি।
তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত “অবৈধ প্রবেশ” আইন অনুযায়ী ২৫৩ জনকে দণ্ডিত করা হয়েছিল। ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৫৫ জনে। এদের অনেকেই সুদান, দক্ষিণ সুদান, লিবিয়া ও সিরিয়ার মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল থেকে এসেছেন।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রায় অর্ধেক অভিযুক্তকে ডিঙ্গি নৌকা চালানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। অনেকেই পাচারকারীদের জোরাজুরিতে বা অর্থের অভাবে নিজেরাই নৌকা চালাতে বাধ্য হন।
২০২২ সাল থেকে যেসব অভিবাসীদের দণ্ডিত করা হয়েছে, তাদের মধ্যে ২৯ জন নিজেকে শিশু বলে দাবি করেছিলেন, কিন্তু হোম অফিস তাদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে গণ্য করে। এর মধ্যে অন্তত ১৮ জনকে প্রাপ্তবয়স্কদের সেলে রাখা হয়েছিল। পরে ২৯ জনের মধ্যে ১৭ জনের শিশু হওয়া প্রমাণিত হয়েছে, বাকিরা এখনো সামাজিক কর্মীদের বয়স নির্ধারণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আছেন। এই ২৯ জনের মধ্যে ২৮ জনই কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান, মূলত সুদান ও দক্ষিণ সুদান থেকে আগত।
প্রতিবেদনটিতে এমন অভিবাসীদের অপরাধী না বানিয়ে মানবিক পথে শরণার্থী আবেদন গ্রহণের ব্যবস্থা চালুর আহ্বান জানানো হয়েছে, যাদের ডিঙ্গি বা লরির পেছনে করেই আসা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
ইয়াসিন নামে এক ১৭ বছর বয়সী কিশোর, যাকে প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে দণ্ডিত করে প্রাপ্তবয়স্কদের সেলে পাঠানো হয়েছিল, পরে সামাজিক সেবার মূল্যায়নে তার শিশু হওয়া প্রমাণিত হয়।
ইয়াসিন জানায়: “আমি যেই সময়টা এলমলি জেলে কাটিয়েছি, তা আমার শত্রুদের জন্যও কামনা করবো না। খুবই খারাপ সময় ছিল। মানুষ ভাবে ছয় মাস আট দিন কিছু না, কিন্তু এটা সহজ নয়। মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে যেতে পারে।”
হোম অফিস সূত্র জানিয়েছে, শিশুদের প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে শাস্তি পাওয়ার ঝুঁকি কমাতে নতুন গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে। এখন থেকে “বয়স-বিতর্কিত” যেসব কেস থাকবে, সেগুলো প্রসিকিউশন অফিসে পাঠানোর সময় CPS-কে জানানো হবে।
একজন হোম অফিস মুখপাত্র বলেন, “আমরা সবাই চাই এই বিপজ্জনক ছোট নৌকা যাত্রা বন্ধ হোক, যা জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলে এবং আমাদের সীমান্ত নিরাপত্তাকে দুর্বল করে। পাচারকারীরা শুধু অর্থের পেছনে ছুটে, তারা এই দুর্বল মানুষগুলোর জীবন-মৃত্যুর তোয়াক্কা করে না।”
তিনি আরও জানান, “নতুন আইন আনা হচ্ছে, যার মাধ্যমে অপরাধী চক্র চিহ্নিত, ধ্বংস এবং বিচারের আওতায় আনার সক্ষমতা বাড়বে, অবৈধ শ্রম প্রতিরোধে আরও পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করা হবে।”
যদিও ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
০২ জুন ২০২৫