যুক্তরাজ্যের একজন বাড়িওয়ালা একদল প্রোপার্টি এজেন্টদের দলের সাথে যোগসাজশ করে ফ্ল্যাট খুঁজতে থাকা লোকদের প্রতারণা ও বিভ্রান্ত করেছেন। যার কারণে আদালত তাকে তিন বছর পাঁচ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করে।
মোহাম্মদ হক ও আরও তিনজনকে গত অক্টোবর মাসে আটটি প্রতারণামূলক ব্যবসার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পঞ্চম অভিযুক্তকে অপেক্ষাকৃত ছোট দুটি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
ট্রেডিং স্ট্যান্ডার্ডসের তদন্তে দেখা যায়, তারা পূর্ব লন্ডনে প্রায় ১৮,০০০ বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপন পোস্ট করেছিল, যা ভাড়াটিয়াদের আকৃষ্ট করত। এরপর তাদের চাপ দিয়ে নিরাপত্তা জমা (ডিপোজিট) দিতে বাধ্য করা হতো, যাতে ভাড়াটিয়ারা “অস্বাস্থ্যকর” অবস্থায় থাকা বাসাগুলোতে উঠতে পারে। ভাড়াটিয়াদের কারো কারো ডিপোজিটের টাকা অনেকক্ষেত্রে আটকা পড়ত, আবার অনেক ক্ষেত্রে ভাড়াটিয়াদের হঠাৎ করে উচ্ছেদ করা হত।
অনেক ভুক্তভোগী জানিয়েছেন, এই অভিজ্ঞতা তাদের আর্থিক ও মানসিকভাবে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছে।
৪৭ বছর বয়সী মোহাম্মদ হক টাওয়ার হ্যামলেটসে বিভিন্ন কোম্পানি পরিচালনা করতেন। যার মধ্যে ছিল Citiside Properties Ltd এবং ফ্লিন্তন্স কোম্পানি। এগুলো একই ঠিকানায় মাইল এন্ড হতে পরিচালিত হতো এবং তার আরও বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক ছিল।
মোহাম্মদ হক, তার সাবেক স্ত্রী ফাতিমা বেগম (৪২), গনজালো এগিয়া (৪৩) এবং রাজাউর অলী (৫১) – এই চারজনকে প্রতারণামূলক ব্যবসায় জড়িত থাকার দায়ে সাউথওয়ার্ক ক্রাউন কোর্টে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
এছাড়া, নজির আহমেদ (৫৬) ও দুটি কোম্পানি (Barrons London Ltd ও Roomshare Ltd) – কে অন্যায় বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালানোর দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
একজন ভুক্তভোগী আদালতে বলেন যে প্রোপার্টি কোম্পানি Flintons তার জীবনকে “নরক” বানিয়ে দিয়েছিল, এবং তিনি আত্মহত্যার কথা চিন্তা করেছিলেন।
অন্য একজন জানান, তিনি ইঁদুরে ভরা ফ্ল্যাটে থাকতে বাধ্য হয়েছিলেন, আবার কেউ কেউ বলেছেন তারা “ভয়ংকরভাবে প্রতারিত” হয়েছেন এবং সর্বস্বান্ত হয়েছেন।
টাওয়ার হ্যামলেটস ট্রেডিং স্ট্যান্ডার্ডসের তদন্তকারী শন রোভাই বলেন, ২০১৭ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে অন্তত ২০০ জন ভুক্তভোগী পাওয়া গেছে, তবে আসল সংখ্যা অনেক বেশি হতে পারে।
তদন্তে উঠে আসে, অভিযুক্তরা বিদেশি কর্মী ও শিক্ষার্থীদের টার্গেট করত, যারা লন্ডনের রেন্টাল মার্কেট সম্পর্কে কম জানত। তারা SpareRoom-এর মতো জনপ্রিয় ওয়েবসাইটে ভুয়া বিজ্ঞাপন দিত, যেখানে উচ্চমানের কক্ষের ছবি দেখানো হলেও বাস্তবে সেই কক্ষ কখনোই খালি থাকত না।
ভাড়াটিয়ারা বড় অঙ্কের ডিপোজিট দিয়ে চুক্তিবদ্ধ হতে বাধ্য হতেন, এবং পরে দেখতেন যে বাসাগুলোর অবস্থা একেবারে নিন্মমানের। কেউ কেউ চাইলেও সেখান থেকে বের হতে পারতেন না।
জুলিয়াস আগেই, যিনি ম্যানচেস্টার থেকে লন্ডনে আসেন, তিনি Flintons থেকে একটি ঘর ভাড়া নিয়েছিলেন। একদিন ঘরে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখেন তার ঘরে ঢুকার তালা বদলে দেয়া হয়েছে এবং চাবি কাজ করছে না।
এক রুমমেট তাকে দরজা খুলে দিলে, তিনি দেখেন তার সমস্ত মালপত্র উধাও!
তিনি জানান, ” আমার রুম পুরোপুরি ফাঁকা ছিল। আমার সব কাপড়, জুতা, পাসপোর্ট, গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র – কিছুই ছিল না। আমি এগুলো আর কখনো ফিরে পাইনি।”
জুলিয়াসকে এক রাত রাস্তায় কাটাতে হয়, পরে তিনি একটি হোমলেস হোস্টেলে আশ্রয় নেন।
ইসরায়েল কুজোরে নামের এক ব্যক্তি Flintons-এ যান একটি ফ্ল্যাট দেখার জন্য, কিন্তু খুব দ্রুত তাদের ডিপোজিট দেওয়ার জন্য বাধ্য করা হয়।
তিনি বলেন, তাদের বয়স কম হওয়ায় প্রতারকরা এই সুযোগ নিয়েছে। মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে তিনি £৩০০ পাউন্ড প্রতারিত হয়েছিলেন।
তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, অনেকেই এত খারাপ অবস্থায় আটকা পড়তেন যে, তাদের আর কোনো উপায় থাকত না।
“অনেকেই বিদেশ থেকে আসতেন, কেবলমাত্র একটি স্যুটকেস নিয়ে। তারা অনলাইনে যে কক্ষ বুক করতেন, সেটি বাস্তবে বিদ্যমানই থাকত না। তারপর তাদের চাপ দিয়ে অন্য কক্ষে উঠতে বাধ্য করা হতো।”
এই প্রতারণার ব্যবসার মূল নীতিই ছিল ‘ভাড়া নিয়ে ভাড়া দেওয়া’ (rent-to-rent)।
তারা বাড়ির মালিকদের নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়া দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নিতো, তারপর সেটিকে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে অননুমোদিতভাবে ভাড়া দিতো যা সম্পূর্ণ অবৈধ।
প্রায় ২০০টি প্রপার্টি তারা এভাবে নিয়ন্ত্রণ করত, এবং এগুলোর বেশিরভাগই অবৈধ ও নিম্নমানের ছিল।
ট্রেডিং স্ট্যান্ডার্ডসের ভাষ্য অনুযায়ী, এই ধরনের অপরাধ দিন দিন বাড়ছে, কারণ লন্ডনের বাসস্থান সংকট গভীর হচ্ছে।
২০১৯ সালে নাগরিক পরামর্শ কেন্দ্র (Citizens Advice) এবং অ্যাকশন ফ্রড (Action Fraud)-এ প্রচুর অভিযোগ জমা হওয়ার পর এই অপরাধীদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়।
সরকারের তদন্ত সংস্থা জানায়, “আমরা শুধু উদাহরণ তৈরি করতে চাইনি, বরং এই বার্তা দিতে চেয়েছি যে এই ধরনের প্রতারণামূলক কার্যক্রম বেআইনি এবং আমরা এর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেব।”
গত মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের সাউথওয়ার্ক ক্রাউন কোর্ট-এ নিম্নলিখিত সাজা ঘোষণা করা হয়:
ফাতিমা বেগম – ৪ মাসের স্থগিত কারাদণ্ড
গনজালো এগিয়া – ২ বছরের স্থগিত কারাদণ্ড + ১৮০ ঘণ্টার বিনা পারিশ্রমিকের কাজ
রাজাউর অলী – ১২ মাসের স্থগিত কারাদণ্ড + ৯ মাসের কারফিউ
নজির আহমেদ – ৪ মাসের স্থগিত কারাদণ্ড + ১৫০ ঘণ্টার বিনা পারিশ্রমিকের কাজ
টাওয়ার হ্যামলেটেসের মেয়র লুৎফুর রহমান বলেন, “যদি কেউ আমাদের বাসিন্দাদের ঠকায়, আমরা তাদের বিচারের আওতায় আনতে সবকিছু করব।”
SpareRoom জানিয়েছে, তারা প্রতারক বাড়িওয়ালাদের নিষিদ্ধ করেছে এবং ভবিষ্যতে এই বিষয়ে আরও কঠোর নজরদারি চালাবে।
সূত্রঃ বিবিসি
এম.কে
২৭ মার্চ ২০২৫