TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের হাঁসের পালক, মটর ডাল, তুলা ও লোহার বড় বাজার বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশ ২ হাজার ৫১৫ ক্যাটাগরির পণ্য আমদানি করে থাকে। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি রপ্তানি পণ্যের শীর্ষ ১০ গন্তব্যের একটি হলো বাংলাদেশ।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজহাঁসের নরম পালকের বাজারের আকার খুবই ছোট। তবে বাজার ছোট হলেও সে দেশের এই পণ্যের দ্বিতীয় প্রধান বাজার হলো বাংলাদেশ। শীর্ষস্থানে আছে ভিয়েতনাম। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে ১ কোটি ১৮ লাখ মার্কিন ডলারের হাঁসের পালক রপ্তানি হয়েছে, যা এই পণ্যে তাদের মোট আয়ের ২২ শতাংশ।

বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের রাজহাঁসের পালকের দ্বিতীয় বৃহত্তম গন্তব্য হলেও অন্য দুটি পণ্যের শীর্ষ রপ্তানি বাজার। পণ্য দুটি হলো, বিশেষ ধরনের ওভেন কাপড় ও বিশেষ ধরনের সুতা। যুক্তরাষ্ট্রের এ দুটি পণ্যের প্রধান গন্তব্য বাংলাদেশ। অবশ্য পরিমাণে তা খুবই কম।

যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি পণ্যের তৃতীয় বৃহৎ রপ্তানি বাজার বাংলাদেশ। সে পণ্য হলো রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল, অর্থাৎ লোহার টুকরা। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে যত পণ্য আমদানি করে, তার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে এই লোহার টুকরা। গত বছর তারা বাংলাদেশে এই পণ্য রপ্তানি করেছে প্রায় ৬৫ লাখ ডলারের। দেশটির পুরোনো লোহার টুকরার শীর্ষ দুই বাজার হলো যথাক্রমে তুরস্ক ও মেক্সিকো।

যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের তথ্য পর্যালোচনা করে এই চিত্র পাওয়া গিয়েছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল বিশ্বের ৬০টি দেশ ও অঞ্চলের সঙ্গে বাংলাদেশি পণ্য আমদানিতেও ‘রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ’ বা ‘পাল্টা শুল্ক’ আরোপ করেন। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের পণ্য রপ্তানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ার কারণে তারা ৩৭ শতাংশ বাড়তি শুল্ক আরোপ করে। যদিও গত বুধবার চীন ছাড়া অন্য সব দেশের ক্ষেত্রেই পাল্টা শুল্ক আরোপ তিন মাসের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেছে দেশটি। তবে ন্যূনতম ১০ শতাংশ শুল্ক বহাল রাখা হয়।

এখন পাল্টা শুল্ক স্থগিত রাখার এই সময়ে (৯০ দিন) যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়িয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে তাদের বাণিজ্যঘাটতি কমানোর কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেশটি থেকে বাংলাদেশের আমদানি কীভাবে বাড়ানো যায়, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি হিসাব অনুযায়ী, গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের পাইন কাঠ, খনন জাহাজ ও কড জাতীয় সামুদ্রিক মাছের দ্বিতীয় প্রধান রপ্তানি বাজার ছিল বাংলাদেশ, যদিও পরিমাণটি ছিল কম। বাংলাদেশে কোটি ডলারের বেশি মূল্যের পণ্য রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রের এমন পণ্যের সংখ্যা ২০।

যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি তথ্যভান্ডারের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত বছর তারা বিশ্বের ২৪টি দেশে ৫ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের হাঁসের পালক রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে শীর্ষ গন্তব্য ছিল ভিয়েতনাম। বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বাংলাদেশ গত বছর শুল্কমুক্ত সুবিধায় ১ কোটি ১৮ লাখ ডলারের হাঁসের পালক আমদানি করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০১৬ সালে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের রাজহাঁসের পালকের শীর্ষ বাজার ছিল বাংলাদেশ।

শীতকালীন পোশাক তৈরিতে ধূসর ও সাদা রঙের রাজহাঁসের পালক ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে সাদা রাজহাঁসের বুক ও পেটের নিচের নরম পালক দিয়ে সবচেয়ে দামি পোশাক তৈরি হয়। হাঁসের পালক থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানি হয় চড়া দামে। যেমন গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের রাজহাঁসের পালক দিয়ে বাংলাদেশের তৈরি একেকটি জ্যাকেটের দাম ছিল ৪০০ থেকে ৪৫০ ডলার, যা বাংলাদেশের ৪৯ হাজার থেকে ৫৫ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা ধরে)।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের নানা দেশ থেকে গত বছর আট কোটি ডলারের হাঁসের পালক আমদানি করেছে বাংলাদেশ। পণ্যটি আমদানি করেছে শুধু ইয়াংওয়ান করপোরেশনের আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো।

যুক্তরাষ্ট্রের লোহার টুকরার তৃতীয় প্রধান রপ্তানি গন্তব্য এখন বাংলাদেশ। গত বছর যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৫৩৫ কোটি ডলারের ১ কোটি ৩২ লাখ টন পুরোনো লোহার টুকরা রপ্তানি করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে রপ্তানি হয় ৬৫ কোটি ডলারের লোহার টুকরা।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে পুরোনো লোহার আমদানিকারক বিএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত বলেন, পুরোনো লোহার বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। তাদের পণ্যের মানও ভালো। এ কারণে রড উৎপাদনে সে দেশ থেকে বাংলাদেশে লোহার টুকরা বেশি আমদানি হয়।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে নিয়মিত মটর ডাল আমদানি হয় না। তবে গত বছর মটর ডাল আমদানি করেছে বাংলাদেশ। তাতেই দেশটির উৎপাদিত মটর ডালের তৃতীয় প্রধান রপ্তানি গন্তব্য হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। তাদের ক্যালসিয়াম কার্বোনেট (কোরাল ক্যালসিয়াম) ও ব্রাজিল নাটের তৃতীয় শীর্ষ গন্তব্য বাংলাদেশ। সে দেশের পশুখাদ্য, রাসায়নিক ও ফ্ল্যাট স্টিলজাতীয় পণ্য আমদানিতে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

মার্কিন তুলার শীর্ষ পাঁচ রপ্তানি বাজারের একটি হলো বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র গত বছর বিশ্বব্যাপী ৫০০ কোটি ডলারের তুলা রপ্তানি করেছে। এ ক্ষেত্রে চীন, পাকিস্তান, ভিয়েতনাম ও তুরস্কের পরের অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। গত বছর দেশটি থেকে বাংলাদেশে আমদানি হয়েছে ২৫ কোটি ডলারের তুলা। যদিও বাংলাদেশে গত বছর মোট তুলা আমদানি হয়েছে ৩৭৩ কোটি ডলারের। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্যাটাগরির কাপড় ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে পাঁচটি পণ্যের পঞ্চম শীর্ষ গন্তব্য হচ্ছে বাংলাদেশ।

এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ২৮টি পণ্যের রপ্তানি গন্তব্য হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ থেকে দশম। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পণ্যগুলো হচ্ছে নিউজপ্রিন্ট, ক্রাফট পেপার, সয়াবিন বীজ, ইঞ্জিন ইত্যাদি।

বেসরকারি খাতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শীর্ষে রয়েছেন দেশীয় ভারী শিল্পের উদ্যোক্তারা। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) হিসাবে, গত বছর যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানি করেছে আবুল খায়ের গ্রুপ। বড় আমদানিকারকদের মধ্য রয়েছে বিএসআরএম গ্রুপ, ওমেরা পেট্রোলিয়াম, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ, জিপিএইচ, কেএসআরএম, টিকে গ্রুপ, ডেল্টা অ্যাগ্রো, আকিজ গ্রুপ, মাহবুব গ্রুপ প্রভৃতি। এর মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান যুক্তরাষ্ট্র থেকে মূলত শিল্পের কাঁচামালই আমদানি করেছে।

আমদানিকারকেরা বলছেন, দূরত্বের কারণে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে সময় লাগে বেশি। পরিবহন খরচও তুলনামূলক বেশি পড়ে। এরপরও পণ্যের মান ও বড় উৎস হওয়ার কারণে সে দেশ থেকে নানা পণ্য আমদানি হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র থেকে মটর ডাল ও সয়াবিন বীজের আমদানিকারক মাহবুব গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, পণ্যের মান, মূল্য, দূরত্ব, সময় ও পরিবহন খরচ—এসব বিষয় বিবেচনা করেই পণ্য আমদানি করা হয়। দূরত্ব বেশি হওয়ার পরও শুধু মান ও অন্যতম উৎস বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিভিন্ন পণ্য আমদানি হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ছে। রপ্তানির মতো আমদানিও প্রতিবছর বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক ট্রেড কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের মোট রপ্তানি পণ্যের ৯১তম গন্তব্য ছিল বাংলাদেশ। দুই দশকের মাথায় ২০২৪ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ২৭ ধাপ এগিয়ে ৬৪তম স্থানে উঠে আসে। বাংলাদেশে শিল্পায়নে পরিবর্তনের ঢেউ শুরু হওয়ার পর মৌলিক ও প্রাথমিক কাঁচামাল আমদানি বাড়ছে, যার একটা বড় অংশ আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

আমদানিকারকেরা জানান, এখন যুক্তরাষ্ট্রের তুলা আমদানিতে গুদাম সুবিধা ও সয়াবিন বীজ আমদানিতে নীতি সুরক্ষা দেওয়া হলে দেশটি থেকে আমদানি দ্বিগুণ বাড়তে পারে। কারণ, এই দুটো পণ্যই বাংলাদেশ বছরে আমদানি করে ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলারের।

যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের অন্যতম আমদানিকারক ডেল্টা অ্যাগ্রো ফুড ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিরুল হক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আমাদের খুবই পরীক্ষিত বাণিজ্যিক অংশীদার। দেশটি থেকে আমদানি বাড়াতে হলে প্রথমেই অশুল্ক বাধা দূর করতে হবে।’

সয়াবিন বীজ আমদানির উদাহরণ দিয়ে আমিরুল হক বলেন, দেশে এখন সয়াবিন বীজ থেকে সয়াবিন তেল ও সয়াকেক উৎপাদিত হচ্ছে।

এরপরও সরকার শুল্কমুক্তভাবে সয়াকেক আমদানির সুযোগ করে দিয়েছে। নীতি সংস্কার করা হলে সয়াবিন বীজের আমদানি বাড়বে, যার সিংহভাগ আসবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে। এই এক পণ্যই শুধু অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ২ বিলিয়ন বা ২০০ কোটি ডলারের আমদানি হতে পারে। এতে দেশে মূল্য সংযোজন হবে, শিল্পায়নে গতি আসবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে।

এম.কে
১৫ এপ্রিল ২০২৫

আরো পড়ুন

গণভবন স্টাইলে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে লুটপাট

ডেঙ্গু টিকার সফল পরীক্ষা বাংলাদেশে

ইবনে সিনায় আহতদের জবানবন্দি নিল প্রসিকিউশন