লন্ডনের আকাশে সূর্য ডুবতে শুরু করলে বেশিরভাগ রাস্তা শান্ত হয়ে আসে—দোকানপাট বন্ধ হয়, কর্মীরা বাড়ি ফেরার তাড়াহুড়ো করে, আর শহর সন্ধ্যার নিজস্ব ছন্দে মিশে যায়। তবে আপনি যদি সঠিক জায়গা জানেন, তাহলে এমন কিছু স্থান খুঁজে পাবেন যেখানে রাত তখনই মাত্র শুরু হয়।
হোয়াইটচ্যাপেল রোড এমনই একটি স্থান। দিনের বেলায় এটি একটি জমজমাট বাজার, যেখানে ব্যবসায়ীরা ফলমূল থেকে শুরু করে পোশাক পর্যন্ত সবকিছু বিক্রি করেন। কিন্তু সন্ধ্যা ছয়টা বাজতেই, যখন দোকানিরা তাদের স্টল গুটিয়ে নিতে শুরু করে, তখন এক ভিন্ন আমেজ ভর করে—একটি অপেক্ষার, একটি সম্প্রীতির, এবং একসঙ্গে ইফতার করার আনন্দের।
সকাল থেকে রোজা রাখা স্ট্রিট ভেন্ডররা দ্রুত তাদের শেষ সামগ্রী বিক্রি করে ঘরে ফেরার প্রস্তুতি নেয়। ক্রেতারাও ব্যস্ত হয়ে পড়ে—হাত ভর্তি ব্যাগ নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে চায়, যেন প্রিয়জনদের সঙ্গে ইফতার করতে পারে।
যারা রান্না করতে চায় না, তাদের জন্য রাস্তায় সারি সারি রেস্তোরাঁ ইফতারি স্টল বসায়। সুগন্ধে ভরা ধোঁয়া উঠতে থাকে বিরিয়ানি, সামোসা, আর হালাল মাংসের প্লেট থেকে। সময় যত গড়ায়, ভিড় তত বাড়তে থাকে হোয়াইটচ্যাপেল রোডে। সবাই চায় একটি গরম ও মজাদার খাবার নিয়ে ইফতার করা।
হোয়াইটচ্যাপেল রোডে মিষ্টির দোকানগুলোও সরগরম থাকে। সোনালি খেজুরের ট্রে আর ঐতিহ্যবাহী রমজানের মিষ্টিতে দোকান উপচে পড়ে। তথ্যমতে জানা যায় জিলাপি সবচেয়ে জনপ্রিয়; পাকিস্তানি এই মিষ্টিটি ময়দার মিশ্রণকে গোল পাকিয়ে ডুবোতেলে ভেজে চিনি সিরায় ডুবিয়ে তৈরি করা হয়।
যারা রেস্টুরেন্টে বসে খেতে চায়, তাদের জন্য বেশিরভাগ রেস্তোরাঁতে বিশেষ রমজান মেনু থাকে। সূর্যাস্ত যত এগিয়ে আসে, কর্মীরা বাইরে এসে ইফতারের বিজ্ঞাপন বিতরণ করে। বাতাসে তখন কাবাবের মসলা, ঘন কারি আর মিষ্টির সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
ফিস্ট অ্যান্ড মিষ্টি রেস্তোরাঁতে বিকেল ৫.৩০টার মধ্যেই সব টেবিল ভরে যায়। মানুষজন ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, তাদের প্লেট তখনও খালি, কিন্তু টেবিল পানির বোতল, জুস, আর ছোট বাটিতে খেজুর দিয়ে সাজানো।
অনেক রেস্তোঁরায় ঘরের মাঝখানে থাকে এক বিশাল বুফে, যেখানে সাজানো থাকে সতেজ প্রস্তুতকৃত হালাল খাবার, সালাদ, ফল, আর লোভনীয় মিষ্টান্ন—যেন ঠিক সময়ে উপভোগ করার জন্য তৈরি। পরিবেশ উষ্ণ, চারপাশে চাপা কথোপকথন আর মাঝে মাঝে ঘড়ির দিকে একবার তাকানোর মুহূর্ত।
হোয়াইটচ্যাপেল রোডে অল্প হাঁটলেই দোয়া ডাইনার রেস্টুরেন্ট, যেখানে বুফের পরিবর্তে মেনু থেকে খাবার বেছে নেওয়া যায়—ঐতিহ্যবাহী রমজান ডিশ থেকে শুরু করে বিশেষ গ্রিল আইটেম পর্যন্ত।
এই রেস্তোরাঁটি এশিয়ান ও হালাল স্বাদের সংমিশ্রণে পরিচিত, এমনকি এখানকার মেনুতে রোস্টও পাওয়া যায়! তবে পুরো ইফতার প্যাকেজ চাইলে, £১৫.৯৯ মূল্যের রমজান সেট মেনুই সেরা পছন্দ।
এই মেনুতে থাকে সুগন্ধি ভাত, এক পিস ল্যাম্ব চপ, কাবাব, মুচমুচে উইংস, আর ঐতিহ্যবাহী খিচুড়ি—ডাল, চাল ও মশলার এক দারুণ সংমিশ্রণ। খাবার শুরু হয় ঠান্ডা গোলাপজল আর খেজুর ও তাজা ফলের প্লেট দিয়ে।
মাগরিবের নামাজ শেষ হলে শুরু হয় প্রকৃত ভোজ। টেবিলভর্তি হয় কাবাব, সুগন্ধি কারি, আর মুচমুচে ভাজা খাবারে।
দোয়া ডাইনার-এর মালিক ইমরান উদ্দিন বলেন, রমজানে তাদের রেস্তোরাঁ প্রতিদিন পরিপূর্ণ থাকে। তিনি বলেন, “এই সময় আমাদের কমিউনিটিকে সেবা দিতে পারা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। আমরাও রোজা রাখছি, তাই এটি সহজ নয়, কিন্তু আমার স্টাফরা অসাধারণ। তারা সার্ভিসের মাঝেই ইফতার করে, আর মাত্র আধা ঘণ্টার মধ্যে শতাধিক ক্রেতার খাবারের ব্যবস্থা নিশ্চিত করে।”
ইমরানের মতে, তার রেস্তোরাঁর বিশেষত্ব হলো খাবারের বৈচিত্র্য। তিনি বলেন, “কেউ চায় ঐতিহ্যবাহী ইফতার, কেউ আবার শুধু বার্গার বা গ্রিলড চিকেন খেতে চায়। আমরা আমাদের এশিয়ান স্বাদকে নতুন কিছু দিয়ে মেশাই, স্বাস্থ্যকর কিছু তৈরি করি। অনেক নিয়মিত ক্রেতা বারবার আসেন, কারণ তারা জানেন এখানে তারা তাদের পছন্দের খাবার পাবেন।”
এক ঘণ্টা পর, ভিড় কমতে শুরু করে। রেস্তোরাঁ ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়; কর্মীরাও অবশেষে বসে তাদের দিনের প্রথম খাবার উপভোগ করে। এভাবেই হোয়াইটচ্যাপেল রোড আবার শান্ত হয়ে আসে—পরের দিনের জন্য।
সূত্রঃ মাই লন্ডন
এম.কে
১৬ মার্চ ২০২৫