লেবার পার্টির কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয় ব্রিটিশদের সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের সাম্প্রতিক অভিবাসন বিষয়ক বক্তৃতায় দেখা দেওয়া প্রতিক্রিয়ার পর, বর্ণবৈষম্যবিরোধী সংগঠনগুলোর তরফে ব্যাপক নিন্দা জানানো হয়েছে। স্টারমার দাবি করেছেন, “নিয়ন্ত্রণহীন” অভিবাসন ব্রিটিশ সমাজে “অপূরণীয় ক্ষতি” করেছে—যা সমতার জন্য কাজ করা বিভিন্ন গোষ্ঠী বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে অভিহিত করছে।
বিশেষজ্ঞদের একটি গ্রুপ সতর্কবার্তা দিয়ে জানিয়েছে—প্রধানমন্ত্রী কেয়ার স্টারমারের অভিবাসন বিষয়ক বক্তব্যে ক্ষুব্ধ বর্ণবৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীরা।
গাজা পরিস্থিতি, দাসত্বের জন্য ক্ষতিপূরণ, সাজা সংস্কার ও বৈদেশিক সহায়তার মতো বিষয়েও লেবার পার্টির সাম্প্রতিক অবস্থান সংখ্যালঘু ও বামঘেঁষা ভোটারদের হতাশ করেছে। অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, লেবার পার্টি রিফর্ম ইউকে-র ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চাইছে, এবং একইসঙ্গে দাবি করছে যে কেবল লেবারই নাইজেল ফারাজের দলকে ঠেকাতে সক্ষম। এতে করে হতাশ বামপন্থী ভোটারদের নিজেদের পাশে রাখার চেষ্টা করছে তারা।
তবে স্টারমারের ভাষা তুলনা করা হচ্ছে টোরি নেতা ইনক পাওয়েলের সাথে, যিনি ১৯৬৮ সালে “রিভার্স অফ ব্লাড” বক্তৃতার মাধ্যমে কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয় ভোটারদের টোরি পার্টি থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিলেন। স্টারমার সম্প্রতি অভিবাসন সংক্রান্ত হোয়াইট পেপার প্রকাশের সময় বলেছিলেন, দেশটি “অচেনা মানুষে ভরা দ্বীপে” পরিণত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
ডেভিড ল্যামির প্রতিষ্ঠিত ‘ব্ল্যাক ইকুইটি অর্গানাইজেশন’ বলেছে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন বক্তব্য নয়, বরং এমন একটি ধারাবাহিক নীতি ও ভাষার অংশ, যা সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মর্যাদা, নিরাপত্তা ও অধিকারকে হুমকির মুখে ফেলছে।
তারা আরও বলেছে: “দাসত্বের জন্য ক্ষতিপূরণের দাবিকে উপেক্ষা, সাজা সংস্কারের বিলম্ব—যা কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর ভারি প্রভাব ফেলে—এবং গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের বিষয়ে লেবারের অবস্থান, এসব একত্রে একটি কাঠামোগত ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি।”
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত স্থানীয় নির্বাচনে রিফর্ম পার্টির কাছে লেবার ১৫৩টি আসন হারিয়েছে। তবে রিফর্মই একমাত্র চ্যালেঞ্জ নয়। মুসলিম ভোটার সংখ্যাধিক্য রয়েছে এমন এলাকায় গাজা ইস্যুতে অসন্তোষের কারণে লেবার ৫টি সংসদীয় আসন হারিয়েছে। ইলফোর্ড নর্থে ওয়েস স্ট্রিটিংয়ের জয়ী ব্যবধান ছিল মাত্র ৫২৮ ভোটে, আর বার্মিংহাম ইয়ার্ডলিতে জেস ফিলিপস টিকে গেছেন মাত্র ৬৯৩ ভোটের ব্যবধানে।
এমনকি লেবারের সবচেয়ে নিরাপদ আসনগুলোতেও দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে গ্রিন পার্টি বা রিফর্ম। লেবার ১৪টি আসন গ্রিনদের কাছে, ১২টি স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কাছে ও ১০টি লিবারেল ডেমোক্র্যাটদের কাছে হারিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অ্যানান্দ মেনন বলেন, “লেবারের জন্য এটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ তারা মূলত শ্বেতাঙ্গ রিফর্ম-ঘেঁষা ভোটারদের আকৃষ্ট করতে চাইছে। অথচ বাস্তবে তারা সব দিক থেকেই ভোট হারাচ্ছে।”
স্টারমারের বক্তব্যে জাতিগত সংখ্যালঘু ব্রিটিশদের অবদানকে খাটো করা হয়েছে বলে অনেকে মনে করছেন, যা লেবারের জন্য রক্তক্ষরণ বাড়াতে পারে। আগের সাধারণ নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গ ও এশীয় ভোটাররা সবচেয়ে বেশি লেবারকে ভোট দিয়েছিল। কিন্তু বৈচিত্র্য প্রথার দিক থেকে এখন কনজারভেটিভরাই এগিয়ে—একজন এশীয় প্রধানমন্ত্রী, একাধিক কৃষ্ণাঙ্গ নেতা, চ্যান্সেলর, হোম সেক্রেটারি ও পার্টি চেয়ার রয়েছে তাদের।
‘ব্রিটিশ ফিউচার’ থিঙ্কট্যাংকের পরিচালক সুন্দর কাটওয়ালা বলেন, স্টারমারের নীতিগুলি যতই ভারসাম্যপূর্ণ হোক, বক্তৃতার ভাষা ছিল সমস্যার মূল।
“নীতিগতভাবে অভিবাসন নিয়ন্ত্রণ ও সহনশীলতা জোরদার করা যেতে পারে, তবে তার জন্য প্রয়োজন ভারসাম্যপূর্ণ ভাষা, যা স্টারমার দেননি,” তিনি বলেন।
মুসলিম কাউন্সিল অব ব্রিটেন বলেছে, স্টারমারের ভাষা “গভীর উদ্বেগের” কারণ হয়েছে, বিশেষ করে যখন ইসলামভীতি বাড়ছে এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি ও যুদ্ধবিরতির বিষয়ে তিনি নীরব থেকেছেন।
সংগঠনের মহাসচিব ড. ওয়াজিদ আখতার বলেন,
“অভিবাসীরা আমাদের সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন—NHS থেকে শুরু করে সামাজিক সেবায়। তাদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত, দোষারোপ নয়।”
রানিমিড ট্রাস্টের প্রধান নির্বাহী শাবনা বেগম বলেন, “স্টারমারের প্রস্তাবনা বাস্তবসম্মত সমাধান নয় বরং রিফর্ম ইউকের ভয়কে কাজে লাগিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা।”
তিনি বলেন, “এর ফলে রঙিন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৈষম্য আরও তীব্র হবে।”
গত মাসে ১০০টিরও বেশি দাতব্য সংস্থা ও এনজিও স্টারমারকে চিঠি লিখে “দানবীয় ভাষা” ব্যবহার বন্ধ করতে আহ্বান জানিয়েছে। স্কটিশ রিফিউজি কাউন্সিলের প্রধান সাবির জাজাই বলেন, স্টারমার “শান্তিতে বাঁচতে চাওয়া সাধারণ মানুষদের ওপর ব্যর্থ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের দায় চাপাচ্ছেন।”
তিনি আরও বলেন, “ স্টারমার এমন একজন মানুষ, যিনি একসময় অভিবাসীদের মর্যাদা ও সহানুভূতির কথা বলতেন, এখন ইচ্ছাকৃতভাবে বিভাজনের পথ বেছে নিচ্ছেন—এটা অত্যন্ত হতাশাজনক।”
‘রেইস অন দ্য অ্যাজেন্ডা’ থিঙ্কট্যাংকও বলেছে, এই ভাষা ব্রিটিশ রাজনীতিতে উদ্বেগজনক প্রবণতার অংশ, যা অভিবাসীদের দোষারোপ করে এবং সরকারের ব্যর্থতাকে আড়াল করে।
২০২৬ সালের স্থানীয় নির্বাচনে, যেসব এলাকায় সংখ্যালঘু ভোটার বেশি, সেখানকার ফলাফলে স্টারমারের এই বক্তব্যের প্রভাব ফুটে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
অ্যানান্দ মেনন আরও বলেন, “সবচেয়ে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে। ডিগ্রিধারী ভারতীয় হিন্দুরা এখন কনজারভেটিভদের দিকে ঝুঁকছেন, যা ব্রিটিশ জনসংখ্যার প্রধান প্রবণতার উল্টো।”
যুক্তরাজ্যের অভিবাসন গঠনে এবং লেবার পার্টির উত্থানে যারা মুখ্য ভূমিকা রেখেছে, সেই জনগোষ্ঠীগুলোকেই এখন উপেক্ষা করা হচ্ছে বলে মনে করছেন অনেকেই।
জয়েন্ট কাউন্সিল ফর দ্য ওয়েলফেয়ার অব ইমিগ্র্যান্টসের আইন বিভাগের প্রধান এনি চৌধুরী বলেন, ” কেয়ার স্টারমার তাদেরই ত্যাগ করছেন, যারা এই দেশ গড়েছে, যাদের ঘাড়ে ভর করে লেবার উঠে এসেছে। আমরা এই বিশ্বাসঘাতকতা ভুলব না।”
প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সাথে যোগাযোগ করা হলেও এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
সূত্রঃ দ্য গার্ডিয়ান
এম.কে
১৮ মে ২০২৫