প্রতি কয়েক বছর পরপর ব্রিটেনে নতুন করে উদ্বেগ দেখা দেয়—শরিয়া আইন ইংরেজ আইনের বিকল্প হয়ে উঠছে। সম্প্রতি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জাতিসংঘে এক বক্তৃতায় দাবি করেন, “লন্ডন শরিয়া আইন চালু করতে চায়।” তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। ব্রিটেনে কোনো পৃথক শরিয়া বিচারব্যবস্থা নেই; বরং এটি দেশের বহুসাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক ঐতিহাসিক ফলাফল।
গবেষকরা দেখিয়েছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উপনিবেশগুলোতে শাসন টিকিয়ে রাখতে একাধিক আইনি কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল। নাইজেরিয়া, ভারতসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ইংরেজ আইন চলত ইসলামিক ও স্থানীয় আইনের পাশাপাশি। এই “বহুত্ববাদী” ব্যবস্থা ছিল একাধারে রাজনৈতিক ও বাস্তববাদী পদক্ষেপ—যা স্থানীয় জনগণের আনুগত্য বজায় রাখত, তবে চূড়ান্ত কর্তৃত্ব থাকত ইংরেজ আইনের হাতে। বর্তমান ব্রিটেনের বহুধর্মীয় সমাজে সেই ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যই আজ নতুন রূপে টিকে আছে।
যুক্তরাজ্যে শরিয়া আইন কোনো স্বাধীন আইনি কাঠামো হিসেবে কার্যকর নয়। বর্তমানে রয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান—শরিয়া কাউন্সিল ও মুসলিম আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল (MAT)। MAT চালু হয়েছে Arbitration Act 1996 অনুযায়ী, যা প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে নাগরিক সালিশের অনুমতি দেয়। কিন্তু এসব সিদ্ধান্ত ইংরেজ আইনের সীমার মধ্যেই বাধ্য।
শরিয়া কাউন্সিলগুলো মূলত ১৯৮০-এর দশক থেকে গড়ে উঠেছে। এগুলোর কাজ বিবাহ, তালাক ও উত্তরাধিকার সংক্রান্ত ব্যক্তিগত বিষয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে পরামর্শ দেওয়া। কোনো আইনি ক্ষমতা না থাকলেও তাদের অস্তিত্ব নিয়ে অনেকে বিভ্রান্ত। ২০১৮ সালের হোম অফিস পর্যালোচনা স্পষ্ট করেছে—এই কাউন্সিলগুলো ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে কোনো আইনি এখতিয়ার রাখে না।
পর্যালোচনাটি দেখায়, শরিয়া কাউন্সিলের প্রায় সব ব্যবহারকারীই নারী, যাদের ৯০ শতাংশই ইসলামী তালাক চান। অনেকের নাগরিক বিবাহ নিবন্ধিত না থাকায় তারা ইংরেজ আদালতে বিচ্ছেদের আবেদন করতে পারেন না। রিপোর্টে বলা হয়, নারীদের সুরক্ষার জন্য আরও স্বচ্ছতা, নাগরিক বিবাহ নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা ও আইনি সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ প্রয়োজন।
তবে সরকার এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রক সংস্থা গঠন করেনি। ফলে, শরিয়া কাউন্সিলগুলোর কার্যক্রম এখনো মূলত স্বেচ্ছাভিত্তিক নীতি ও ভালো চর্চার ওপর নির্ভর করছে।
ব্রিটেনে শুধু মুসলিম নয়, ইহুদি Beth Din আদালত ও রোমান ক্যাথলিক ট্রাইব্যুনালও ধর্মীয় সালিশ পরিচালনা করে থাকে। এদের কেউই ইংরেজ আইনের বাইরে নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি ব্রিটেনের আইনি বহুত্বের প্রমাণ—যেখানে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় নিজেদের ধর্মীয় রীতি পালন করতে পারে, তবে নাগরিক আইনের কাঠামোর মধ্যেই।
শরিয়া বিতর্ককে তাই অনেকেই দেখছেন ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকারের এক স্বাভাবিক প্রকাশ হিসেবে। আধুনিক ব্রিটেনের চ্যালেঞ্জ এখন এই—কীভাবে শরিয়া কাউন্সিলসহ সব ধর্মীয় সালিশি প্রতিষ্ঠানকে ন্যায্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, যেন প্রত্যেক নাগরিক ধর্ম নির্বিশেষে ইংরেজ আইনের অধীনে তার অধিকার নিশ্চিতভাবে ভোগ করতে পারে।
সূত্রঃ দ্য কনভার্সেশন
এম.কে

