সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) আলোচিত-সমালোচিত উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক মো. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ পদত্যাগ করেছেন। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে আজ শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। গণমাধ্যমকে বিষয়টি বিকেলে নিশ্চিত করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রো-ভিসি) অধ্যাপক ড. মো. কবির হোসেন। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য এক বার্তাও দিয়েছেন। যেখানে তিনি লিখেছেন, শিক্ষার্থীরা চাইলে তিনিও পদত্যাগ করতে প্রস্তুত রয়েছেন।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক এস এম সাইফুল ইসলাম, পরিবহন প্রশাসক অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন, মেডিকেল প্রশাসক অধ্যাপক আশিফ ইকবালও পদত্যাগ করেছেন। তারা পৃথকভাবে আজ শনিবার বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার মো. ফজলুর রহমানের কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। রেজিস্ট্রার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার সব আবাসিক হলের প্রভোস্ট, সহকারী প্রভোস্ট ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা পদত্যাগ করেছে। ওই দিন সকালে সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন। এর আগে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনরত শাবি শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পদত্যাগ চেয়ে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেন।
উল্লেখ্য যে, ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুন্নেসা চৌধুরী হলের প্রাধ্যক্ষ জাফরিন আহমেদের বিরুদ্ধে অসদাচরণের অভিযোগ তুলে তার পদত্যাগসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন হলের কয়েক শ ছাত্রী। এ দাবিতে আন্দোলন চলাকালে ১৬ জানুয়ারি উপাচার্যকে অবরুদ্ধ করেন আন্দোলনকারীরা। ওই দিন সন্ধ্যায় পুলিশ শিক্ষার্থীদের লাঠিপেটা করলে দুই পক্ষে সংঘর্ষ বাধে। এরপর রাবার বুলেট ও সাউন্ড গ্রেনেড ছুড়ে শিক্ষার্থীদের ছত্রভঙ্গ করে উপাচার্যকে মুক্ত করে বাসায় নিয়ে যায় পুলিশ। পরে রাতে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের হল ছাড়ার নির্দেশ দেন উপাচার্য। এ নির্দেশনা উপেক্ষা করে ওই রাত থেকেই শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের পদত্যাগ দাবিতে আন্দোলন শুরু করেন। পরদিন থেকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে টানা অবস্থান নেন তারা। সেখানে ২৮ শিক্ষার্থী টানা ১৩৬ ঘণ্টা অনশন করেন। ২৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের আশ্বাসে শিক্ষার্থীরা অনশন ভেঙে ব্যারিকেড তুলে নেন। এ ঘটনায় ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত হন ভিসি ফরিদ আহমদ।
এদিকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে একটি চিঠি দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. কবির হোসেন। তিনি লিখেন, ‘স্নেহভাজন শাবিপ্রবির ছাত্রছাত্রীবৃন্দ, আমার শুভেচ্ছা নিও। কোটা সংস্কার আন্দোলনে শহীদ আবু সাঈদসহ যে সকল ছাত্রছাত্রী, সাধারণ জনগণ শহীদ হয়েছেন সে সকল বীর শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা করছি। সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে আমার স্নেহভাজন ছাত্রছাত্রীদের কিছু কথা বলতে চাই। আমি শাবির প্রথম প্রভাষক হিসেবে প্রায় ৩৪ বছর চাকরিকালে দল-মত নির্বিশেষ শাবির একাডেমিক ও প্রশাসনিক বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করে আসছি। আমার স্নেহভাজন হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী দেশে-বিদেশে প্রতিষ্ঠিত। আমি সবার জন্য অন্তর থেকে দোয়া করি। আমার শিক্ষকতা জীবনে যেসব ছাত্র-ছাত্রীর ক্লাস-পরীক্ষা নিয়েছি কিংবা নিজ বিভাগসহ অন্যান্য বিভাগের সকল ছাত্র-ছাত্রী যেসব সমস্যা নিয়ে এসেছে, তা সমাধানের চেষ্টা করেছি ও সমাধান করেছি তা ছাত্রছাত্রীরাই আমার সম্পর্কে ভালো বলতে পারবে।’
ড. কবির হোসেন আরও লিখেন, ‘এক বছর আগে রাষ্ট্রপতি আমাকে চার বছরের জন্য প্রো-ভিসি নিয়োগ দিয়েছেন। প্রো-ভিসি হিসেবে নিয়োগের পর ভাইস চ্যান্সেলরের নির্দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শুধু উন্নয়নমূলক কাজের গুণগত মান যাচাই-বাছাই ও তদারকির দায়িত্ব পালন করছি। ফলে এক বছরের মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি/মোটরসাইকেল/বাইসাইকেল রাখার জন্য পার্কিং তৈরি, সমাজবিজ্ঞান ভবনের সামনের রাস্তা তৈরি এবং সম্প্রতি সমাজবিজ্ঞান ভবন থেকে প্রথম ছাত্রী হল হয়ে মেইন রোড পর্যন্ত হাঁটার এবং গাড়ি চলার রাস্তার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ ছাড়া শাহপরান হল থেকে মেইন গেট পর্যন্ত রাস্তা সংস্কার, হ্যান্ডবল গ্রাউন্ড ও কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে মাটি ভরাট করে ব্যবহারের উপযোগী করা এবং শাবি মেডিকেল সেন্টার সংস্কার, উন্নয়নসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছি।’
উপ-উপাচার্য চিঠিতে লিখেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জানতে পেরেছি, আমি সিলেট ছেড়ে পালিয়েছি এ ধরনের খবর রটানো হচ্ছে। কেউ কেউ পদত্যাগ করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখালেখি করছেন। বিষয়টি আমি সুস্পষ্ট করতে চাই, জীবনের অর্ধেক সময়ের বেশি শাবিতে শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি এবং দীর্ঘদিন থেকেই সিলেটে বাসা তৈরি করে পরিবারসহ বসবাস করছি। আমি বর্তমানে নিজ বাসায় অবস্থান করছি।’
উপ-উপাচার্য ড. কবির হোসেন আরও লিখেন, ‘আমার প্রাণপ্রিয় ছাত্রছাত্রী, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সংশ্লিষ্ট সকলকে অনুরোধ করব বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো সমস্যা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দ আমার সঙ্গে যেকোনো স্থানে আলোচনা করতে চাইলে আমি তোমাদের স্বাগত জানাই। প্রো-ভিসি হিসেবে সুস্পষ্ট করে আমার সন্তানতুল্য ছাত্রছাত্রীদের বলতে চাই, প্রায় ৩৪ বছর শিক্ষকতা করার পর যদি মনে করো, আমার সেবা তোমাদের আর প্রয়োজন নাই, তাহলে বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দিক নির্দেশনায় মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে আমি পদত্যাগ করতে সর্বদা প্রস্তুত আছি।’
এম.কে
১০ আগস্ট ২০২৪