২০২৪ সালের ৫ আগস্ট লাখ লাখ বিক্ষোভকারী যখন ঢাকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো, তখন তিনি দেশ থেকে পালানোর জন্য একটি সামরিক হেলিকপ্টারে চড়েছিলেন। দেশ ছাড়ার এত তাড়াহুড়ো ছিল যে, জাতির উদ্দেশ্যে যে ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন তাও রেকর্ড করতে পারেননি তিনি। কিন্তু ১৫ বছর ধরে কঠোর হাতে শাসন করা হাসিনার সাম্রাজ্য কীভাবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ভেঙে পড়ল?
এটা কি কেবল ছাত্র-নেতৃত্বাধীন আন্দোলনের চেয়েও বেশি কিছু ছিল? প্রশ্ন উঠছে যে, হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের সহায়তায় শহুরে গেরিলা ধাঁচের আক্রমণ এবং সামরিক বাহিনী হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার মনোভাব কি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের পতনে আন্দোলনের মতোই বড় ভূমিকা পালন করেছিল?
ঢাকায় বসবাসকারী বাংলাদেশি রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ও কর্মীরা, সেইসঙ্গে সেচ্ছায় নির্বাসনে থাকা ব্যক্তিরা বর্ণনা করেছেন যে, এটি ছিল অনেকটা ঝড়ের মতো, উপরোক্ত সমস্ত কিছুর সমন্বয়ে তৈরি হওয়া এই ঝড় হাসিনার শাসনব্যবস্থাকে কার্যত উড়িয়ে দিয়েছিল। একসময় হাসিনার আওয়ামী লীগ এবং তার যুব সংগঠন ছাত্রলীগের পেছনে ছিল নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা এবং পদাতিক সৈন্যদের সমর্থন। এই গণবিক্ষোভে নিরাপত্তা কর্মীরা নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালায়। পুলিশও প্রতিশোধমূলক হামলার শিকার হয়।
সরকারিভাবে নিহতের সংখ্যা ১,৪০০ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি হতে পারে। বাংলাদেশি-আমেরিকান রাজনৈতিক বিশ্লেষক শাফকত রাব্বি বলেছেন, এটি ছিল দুর্ঘটনা এবং সামগ্রিক পরিস্থিতির একটি সংমিশ্রণ। যা স্বৈরাচারী হাসিনার পতন ডেকে আনে।
রাব্বি আলোচনায় উঠে আসে, কীভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিওগুলো বাংলাদেশি সমাজের সকল স্তরকে হাসিনার বিরুদ্ধে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা থেকে একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ইন্ডিয়া টুডে ডিজিটালকে বলেন, ‘হাসিনাবিরোধী শক্তিগুলো প্রশাসনের মধ্যে বছরের পর বছর ধরে লোকদের ইন্ধন জুগিয়ে এসেছে। ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলন যখন চরমে ওঠে, তখন সেই কর্মকর্তারা কাজ করা বন্ধ করে দেয়, যার ফলে রাষ্ট্রযন্ত্র সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়ে। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মতো রাজনৈতিক দলগুলো, যাদের হাসিনার শাসনামলে দমন করা হয়েছিল, তারাও হাসিনার পতনে তাদের ভূমিকা পালন করেছিল বলে একমত বিশেষজ্ঞরা। ছাত্ররা বিরোধীদলগুলোর ‘স্ট্রিট ফাইটারদের’ সমর্থন ছাড়া এক রাতও টিকতে পারত না, যারা পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা দিয়ে তাদের রক্ষা করেছে।
বাংলাদেশি রাজনৈতিক কর্মী ও লেখক ফাহাম আবদুস সালাম বলেন, ‘পুলিশ কর্মীদের ওপর যখন আক্রমণ নেমে আসে, তখন বোঝা যায় আন্দোলনটি পরবর্তী পর্যায়ে চলে গেছে এবং হাসিনা সরকারকে মানুষ আর ভয় পাচ্ছে না।’
হাসিনা সরকারের কফিনে শেষ পেরেকটি ছিল সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের ঘোষণা যে, বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাবে না। এই ঘোষণা জনতাকে বাড়তি অক্সিজেন দেয়। কারণ এই আন্দোলনে ছাত্র, সাধারণ মানুষ এবং রাজনৈতিক ও ইসলামী সংগঠনের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সামরিক বাহিনীর মধ্যে কেউ কেউ ৫ আগস্টের পরেও যদি হাসিনা ক্ষমতায় থাকেন তবে গেরিলা বাহিনী তৈরির চিন্তাভাবনা করতে শুরু করেছিলেন। এক বছর পর, সেই আন্দোলনের ঝাঁঝ কমে আসার সাথে সাথে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকে তিনটি স্বতন্ত্র পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে, যা হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল এবং সামরিক বাহিনীর ভূমিকা প্রকাশ করে। যদিও এখনও পর্যন্ত জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকে কেবল ছাত্র-নেতৃত্বাধীন একটি আন্দোলন হিসেবেই ধরা হয়। এখানে পরপর তিনটি কারণ তুলে ধরা হলো-
১. শিক্ষার্থীদের কোটাবিরোধী আন্দোলন অবশেষে হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়।
২. বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণের পর বাংলাদেশ জুড়ে বিক্ষোভ, গেরিলা ধাঁচের হামলায় পুলিশ নিহত।
৩. সেনাবাহিনী হাত তুলে দেয়ার নীতি গ্রহণ করে, এমনকি প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের আবাসনগুলোতেও প্রতিবাদ মাথাচাড়া দেয়।
নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ভিডিওগুলো হাসিনা-বিরোধীদের কাছে হাতিয়ার ছিলঃ
২০২৪ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় ফিরে আসেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনটি বয়কট করে এবং অভিযোগ করা হয় যে, এটিতে কারচুপি করা হয়েছে। নির্বাচনটি সাজানো ছিল। দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থায় মানুষ ক্লান্ত ছিল, কিন্তু প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জোরপূর্বক গুমের ঘটনা মানুষকে চুপ থাকতে বাধ্য করেছিল। আয়না ঘরের নির্মম নির্যাতনের ভয়ে কিছু সেরা মস্তিষ্কের মানুষ বাংলাদেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিল। সরকার কেবল হাসিনার বন্ধু এবং আওয়ামী লীগপন্থীদের জন্য কাজ করছে বলে দেখা গেছে। এর মধ্যেই জুন মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্টের ১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধরদের জন্য (যাদের হাসিনার সমর্থক হিসেবে দেখা হয়) সিভিল সার্ভিসের চাকরিতে ৩০% কোটা পুনর্বহালের সিদ্ধান্তটি সামনে আসে। এই ঘটনা নতুন করে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এমন একটি দেশে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমেছিল যেখানে লাখ লাখ মানুষ সরকারি চাকরিকে দারিদ্র্য থেকে মুক্তির একমাত্র উপায় বলে মনে করে।
জুলাই মাসে বিক্ষোভ তীব্র আকার ধারণ করে এবং হাসিনার ছাত্রদের ‘রাজাকার’ হিসেবে আখ্যা দেয়া, যা বাংলাদেশে অত্যন্ত ঘৃণ্য একটি শব্দ। এটি অনুঘটকের মতো কাজ করে। বিক্ষোভ সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে ছাত্রলীগের সদস্যরা পুলিশের সাথে মিলিত হয়ে ঢাকার রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ১৬ জুলাই পুলিশের গুলিতে ২৫ বছর বয়সী ছাত্র আবু সাঈদসহ ছয়জন বিক্ষোভকারী নিহত হন।
গত এক দশক ধরে অস্ট্রেলিয়ায় স্ব-আরোপিত নির্বাসনে বসবাসকারী সালাম বলছেন, ‘১৭ জুলাইয়ের পর হাসিনা সরকারের সবকিছু পদক্ষেপ ছিল আন্দোলন দমন করার জন্য। মানুষ প্রতিশোধ নেয়। পাল্টা হিসেবে সরকার নির্বিচারে মানুষ হত্যা শুরু করে।’
আবু সাঈদের পুলিশের গুলির সামনে বাহু প্রসারিত করে রাখার ছবি বিক্ষোভের সংজ্ঞা বদলে দেয়। বিক্ষোভকারীদের ওপর নৃশংস হামলা এবং হত্যার ভিডিও বাংলাদেশি সমাজের সকল অংশকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল।
ঢাকার রাজনৈতিক ভাষ্যকার সালাম বলছেন, ‘পরবর্তীতে এই আন্দোলন পরিচালনার জন্য নেয়া হয় শহুরে গেরিলা কৌশল।’ হাসিনা তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিয়ে শান্তি স্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক দফা দাবি নিয়ে সামনে আসে-শেখ হাসিনার পদত্যাগ। বেশিরভাগ জৈবিক প্রতিবাদ প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক বা নাগরিক সমাজের সমর্থন ছাড়া কয়েক দিনের বেশি স্থায়ী হয় না। ছাত্রদের নেতৃত্বে আন্দোলন টিকে ছিল। বিক্ষোভকারীরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ ধরে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলো, যা হাসিনার পতনে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সেনাবাহিনীর ভূমিকার দিকে ইঙ্গিত করে।
বিএনপি ও জামায়াতের কর্মীরা ছাত্রদের পাশে ছিলঃ
হাসিনার আমলে রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার বিএনপি এবং জামায়াতের মতো রাজনৈতিক দলগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পরিস্থিতি এমন ছিল যে, জামায়াত বছরের পর বছর ধরে ঢাকায় তাদের সিল করা অফিসের তালাও খুলতে পারেনি। ছাত্রদের বিক্ষোভ এই রাজনৈতিক দলগুলোকে যেন অক্সিজেন যুগিয়েছিল এবং তারা হাসিনার রাষ্ট্রযন্ত্রের উপর পূর্ণ মাত্রার আক্রমণ শুরু করার জন্য ছাত্রদের আন্দোলনকে ব্যবহার করেছিল।
সালাম ইন্ডিয়া টুডে ডিজিটালকে বলেন, ‘১৯ জুলাইয়ের পর থেকে পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দ্বারা নয়, বরং বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর কর্মী এবং দিনমজুরদের দ্বারা আক্রমণের শিকার হয়েছিল। যারা ততক্ষণে বিক্ষোভে সামিল হয়েছে।’ এর প্রমাণ হিসেবে পাঁচটি ভ্যানে করে নিরাপত্তা কর্মীদের একটি দলকে তাড়িয়ে দেয়ার একটি ভিডিও সামনে আসে, যা ভাইরাল হয়েছিল। সালাম সেই ভিডিওর কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আপনি দেখতে পাচ্ছেন যে, একজন ব্যক্তি পুলিশের দিকে দৌড়াতে শুরু করে এবং তারপর জনতা তার পিছু পিছু পুলিশদের ধাওয়া করতে শুরু করে। যে ব্যক্তি প্রথমে পুলিশদের ধাওয়া করতে শুরু করেছিল তাকে পরে বিএনপি সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এটি ঘটেছিল। পুলিশের বিরুদ্ধে আক্রমণের নেতৃত্বদানকারীরা হয় বিএনপি বা জামায়াত সদস্য অথবা দিনমজুর ছিলেন।’
রাব্বি বলেন, ‘সকল রাজনৈতিক দলের মধ্যে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময় বিএনপি-এর তরফে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক নিহত কর্মীর হিসাব পাওয়া যায়। এটাই ছিল তার কারণ।’ রাব্বি ইন্ডিয়া টুডে ডিজিটালকে বলেন, ‘বিএনপির মতো দলগুলোতে অভিজ্ঞ নেতৃত্ব ছিল যারা, তারা জানত আন্দোলনে কীভাবে টিকে থাকতে হয় এবং সরকারের বিরুদ্ধে কীভাবে লড়াই করতে হয়। তরুণ ছাত্র নেতারা জনসাধারণকে আকৃষ্ট করেছিল এবং বিএনপি ও জামায়াত নেপথ্যে থেকে তাদের শক্তি প্রদান করেছিল এবং আন্দোলনের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে তুলেছিল। ছাত্র নেতারা যখন পলাতক ছিল তখন তাদের শারীরিক নিরাপত্তা এবং নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছিল বিএনপির মতো প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো।’
সালাম বলেন, ‘অনলাইনে প্রতিবাদীদের সঙ্গে মোকাবিলা করা হাসিনা সরকার দু’টি বিষয় নিয়ে ভীত ছিল। সেটা হলো-বাংলাদেশি প্রবাসীদের দ্বারা রেমিট্যান্স বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং পুলিশ স্টেশনে আক্রমণ। সালাম ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘পুলিশের পর আক্রমণকারীদের হামলা এমন এক উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, যা দেখিয়ে দিয়েছিল যে আন্দোলন পরবর্তী পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। প্রতিশোধের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছিল যে, মানুষের ওপর হাসিনার শাসনের ভয় চলে গেছে এবং সরকারের পতন হতে পারে।’
৫ আগস্ট হাসিনা বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর সবচেয়ে ভয়াবহ সহিংসতা ঘটেছিল, যা প্রমাণ করে যে রাস্তার সংঘর্ষে ছাত্ররা বেশিরভাগই জড়িত ছিল না। রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল, যেখানে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বহু নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল। ঢাকাভিত্তিক ভাষ্যকার সালাম বলেন, ‘পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের ওপর আক্রমণের ক্ষেত্রে ইসলামী সংগঠনের সদস্যরা এবং জামায়াতের সদস্যরা এগিয়ে ছিল। তারা হাসিনা সরকারকে পতনের জন্য শহুরে গেরিলা কৌশল অনুসরণ করেছিল এবং তারপর প্রতিশোধ নিয়েছিল।’ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ কয়েকদিন ধরে আইনশৃঙ্খলার অভাব ও বিশৃঙ্খলার মধ্যে ডুবে ছিল। যার জেরে সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর গুলি না চালানোর সিদ্ধান্ত খেলা বদলে দেয়ঃ
২০২৪ সালের জুন মাসে ওয়াকার-উজ-জামানকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়, যখন দেশ ইতিমধ্যেই উত্তপ্ত ছিল। একাধিক সূত্র অনুসারে, হাসিনার আত্মীয় জামান পুরো আন্দোলনের সময় দায়িত্বের সঙ্গে কাজ করেছিলেন। বাংলাদেশ যখন সংঘর্ষের সাক্ষী ছিল, তখন ওয়াকার-উজ-জামান এমনকি শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের একটি ঘনিষ্ঠ দলকে বলেছিলেন যে, যদি তারা কখনও মনে করেন যে তার পদক্ষেপ দেশের স্বার্থের পরিপন্থী, তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন। বৈঠকের বিস্তারিত তথ্য সম্পর্কে অবগত একটি সূত্র ইন্ডিয়া টুডে ডিজিটালকে এ কথা জানিয়েছে। ততক্ষণে ঢাকার ডিফেন্স অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এটি ছিল নজিরবিহীন, কারণ হাসিনা সামরিক অফিসারদের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং তাদের সন্তানরা তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছল পরিবেশে লালিত-পালিত হচ্ছিলো।
রাব্বি বলেন, ‘হাসিনা কেবল সেনাবাহিনীর যত্নই নেননি, বরং সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রোধ করার জন্য তিনি সংবিধানও পরিবর্তন করেছিলেন। যা রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধের সামিল।’ কিছু বেসামরিক কর্মকর্তার মতো নিম্নপদস্থ অফিসার এবং সিপাহিরাও ততক্ষণে আইন অমান্যের নীতিতে চলে গিয়েছিলেন। ৪ আগস্ট লাখ লাখ লোক যখন ঢাকা অভিমুখে লং মার্চের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলো, তখন দেখামাত্র তাদের গুলি করার নির্দেশ দেন হাসিনা, জারি করা হয় কারফিউ।
৪ আগস্ট ওয়াকার-উজ-জামান শীর্ষ সেনা কমান্ডারদের সঙ্গে এক বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন যে, তার বাহিনী বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি চালাবে না। এটি সামরিক কর্মকর্তাদের আগেই বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনিচ্ছুক থাকার প্রবণতা বিক্ষোভকারীদের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তোলে। ৫ আগস্ট ভোরবেলায় লাখ লাখ মানুষ ঢাকার রাজপথে জড়ো হয়। ঠিক সেই সময় জেনারেল জামান হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে সামরিক হেলিকপ্টারে চড়ে জীবন বাঁচাতে বলেন। রাব্বি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর চাপ হাসিনা সরকারকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। কারণ ঢাকার রাস্তায় বিপুল সংখ্যক মানুষের হাতে থাকা ইট-লাঠি, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানের হাতে থাকা গোলাবারুদের সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ছিল। সেনাবাহিনী কেবল হাত গুটিয়ে বসে থাকার নীতিই গ্রহণ করেনি, বরং কিছু নিম্নপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাও হাসিনা ৫ আগস্টের পরেও ক্ষমতায় থাকলে শাসনব্যবস্থার পতন ঘটানোর বিকল্প খুঁজছিলেন। একজন সামরিক কর্মকর্তা সালামকে জানিয়েছেন, ‘৫ আগস্ট হাসিনা যদি পালিয়ে না যেতেন, তাহলে নগর গেরিলা যুদ্ধের জন্য বেসামরিক নাগরিকদের হাতে অস্ত্র দেয়ার কথা তিনি বিবেচনা করেছিলেন। এর থেকেই বোঝা যায় গৃহ যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ‘
হাসিনার বাংলাদেশ ত্যাগ কেবল ছাত্র আন্দোলনের কারণে নয়ঃ
যদিও ছাত্ররাই বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে তুলেছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দল এবং ইসলামী সংগঠনগুলো লড়াইয়ে তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে সামিল হওয়ায় এই আন্দোলন একটি অগ্নিকুণ্ডে পরিণত হয়েছিল। মর্গে থাকা মৃতদেহ এবং আহতদের অবস্থা প্রকাশ করে যে, রাস্তার সংঘর্ষে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সংগঠনগুলো কতটা মাত্রায় অংশগ্রহণ করেছিল। বিজয় নিশান উড়িয়ে কর্মীদের উল্লাস থেকে আরও স্পষ্ট হয় যে, সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তর নিশ্চিত করেছে যাকে অভ্যুত্থান হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে, যা আন্দোলনের মুখ ছিল বিশাল জনতা।
রাব্বি সার সংক্ষেপে বলেন, ‘হাসিনার শাসনের পতন ঘটে কারণ শেষের দিকে বাংলাদেশি সমাজের সকল অংশের কাছে তিনি অজনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। যার মধ্যে রয়েছে সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক শ্রেণি, সামরিক বাহিনী, এমনকি তার ঘনিষ্ঠরাও। যারা শেষের দিকে তাদের তাস খেলেছিল, যাতে ১৫ বছরের শাসন ভেঙে পড়ে।’
সূত্রঃ ইন্ডিয়া টুডে
এম.কে
০৬ আগস্ট ২০২৫