মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাধানগর গ্রাম পুরোপুরি বদলে গেছে পর্যটনের ছোঁয়ায়। একসময় এ গ্রামের মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল আখ চাষ। তবে আখ চাষে লাভবান না হওয়ায় তারা পরবর্তীতে লেবু, কাঁঠাল ও আনারস চাষাবাদে ঝুঁকেন। কিন্তু তাতেও কাঙ্ক্ষিত সাফল্য না পাওয়ায় দীর্ঘদিন কৃষিনির্ভর জীবনই ছিল রাধানগরের মানুষের ভরসা।
সবুজ পাহাড় আর নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা এ গ্রামটি নতুন মাত্রা পায় ২০০৮ সালে। সেবার গ্রামে নির্মিত হয় দেশের প্রথম পাঁচতারকা মানের পর্যটন কেন্দ্র গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফ। এর মাধ্যমে রাধানগরের ইতিহাসে সূচনা হয় নতুন অধ্যায়ের। এরপর থেকেই এ গ্রামটি পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা শহর থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি টিলাভূমির এ গ্রামে এখন চোখে পড়ে নান্দনিক রিসোর্ট, আধুনিক কটেজ ও ইকো-রিসোর্ট। বর্তমানে রাধানগরে রয়েছে প্রায় ৪০টি রিসোর্ট, কটেজ ও ইকো-কটেজ। কোথাও নতুন রিসোর্ট নির্মাণ কাজ চলছে, কোথাও খোলা হচ্ছে রেস্তোরাঁ। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের ভিড়ে সারা বছর সরগরম থাকে এ গ্রাম।
গ্রামের স্থায়ী বাসিন্দা ও প্রথম ইকো-কটেজ নিসর্গ নীরব এর পরিচালক কাজী শামসুল হক বলেন, আগের রাধানগর আর এখনকার রাধানগর এক নয়। এখন গ্রামের মানুষ অনেকটাই সচ্ছল।
ঢাকার বাসিন্দা কুমকুম হাবিবা কয়েক বছর আগে রাধানগরে জমি কিনে শুরু করেন পর্যটন ব্যবসা। তিনি এখন অরণ্যের দিনরাত্রি নামের একটি ইকো-কটেজ পরিচালনা করছেন।
তার মতে, ‘এ গ্রামে রাতে এখনও জোনাকিদের মেলা বসে। আসলে গ্রামের সৌন্দর্যে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি, বদলেছে শুধু বিদ্যুতের লাইটপোস্ট।’
গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফের জেনারেল ম্যানেজার আরমান খান জানান, ২০১৩ সালের পর থেকে এ গ্রামে পর্যটন শিল্পের বিকাশ শুরু হয়। বর্তমানে এ গ্রামকে ঘিরে শতকোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। এতে সচল হয়েছে স্থানীয় অর্থনীতি, তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জন স্থানীয় যুবক কাজ করছেন পর্যটন খাতে।
পর্যটকদের আকর্ষণের অন্যতম কারণ এ গ্রামের ভৌগোলিক অবস্থান। কাছেই রয়েছে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ও বিস্তীর্ণ সবুজ চা-বাগান। ফলে শ্রীমঙ্গলে বেড়াতে আসা প্রায় প্রত্যেক পর্যটকই ভিড় জমান রাধানগরে।
ঢাকা থেকে আসা শাবরিনা নামের এক পর্যটক জানান, ‘আমি একাধিকবার এসেছি এখানে। জায়গাটি এতটাই সাজানো গোছানো যে বোঝাই যায় না এটি গ্রাম নাকি শহর।’
অন্য এক পর্যটক রাসেল বলেন, ‘এখানে পাহাড়ের ক্ষতি না করেই ইকো সিস্টেম ধরে রেখে উন্নয়ন হয়েছে। তাই দেশের অন্যতম পর্যটনস্থল হিসেবে রাধানগর এখন অনন্য।’
রাধানগর পর্যটন কল্যাণ পরিষদের সদস্য সচিব মো. তারিকুর রহমান পাপ্পু মনে করেন, শুধু পর্যটকদের কারণে নয়, এখানকার মানুষের আন্তরিকতা ও আত্মীয়তা পরায়ণ আচরণও রাধানগরের সাফল্যের অন্যতম কারণ।
বর্তমানে রাধানগর শুধু একটি গ্রাম নয়, বরং মৌলভীবাজার জেলার পর্যটনের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কৃষি নির্ভর অতীত পেরিয়ে রাধানগর আজ বাংলাদেশে পর্যটনের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
এম.কে
০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫