3.1 C
London
February 19, 2025
TV3 BANGLA
বাংলাদেশ

সিআরআইয়ের নামে যত অপকর্ম করতেন ফরহাদ-তন্ময় জুটি

মূলত সিআরআই ছিলো ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের গুজব ছড়ানোর ট্যাংক। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষকে ডিজিটালি দমন করাই ছিলো এর প্রধান কাজ। আর এই গুজব ট্যাংকের অন্যতম প্রধান দুই কারিগর ছিলেন সিআরআইয়ের সিনিয়র অ্যানালিস্ট ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ ও মিডিয়া-উইংয়ের প্রধান তন্ময় আহমেদ। জুলাই গণহত্যায় সিআরআই-এর ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য।

ছাত্র সমন্বয়কদের অবস্থান নির্ণয়, যোগাযোগ, পরিকল্পনা ইত্যাদি সনাক্ত করতে সক্রিয়ভাবে কাজ করেছেন সিআরআইয়ের ফরহাদ-তন্ময় জুটি। সেসময় গণঅভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কাজ করতে একটি দলকে নিয়মিত প্রশিক্ষণও দেয় আওয়ামী সরকারের সিআরআই।

নিজেকে আওয়ামী পরিবারের সন্তান হিসেবে পরিচয় দিলেও, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী শাহ আলী ফরহাদের বাবা ফরহাদ রহমান মাক্কি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর কাছে ‘মাক্কি রাজাকার’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীতে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা পরিচয় দিয়ে তিনি আওয়ামী রাজনীতিতে নাম লেখান, সরকারের বিভিন্ন পদে চাকুরী করেন এবং অতিরিক্ত সচিব হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

বাবার ছায়া অনুসরণ করেই ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সুঁই হয়ে ঢুকে, কামান হয়ে বের হন। ২০২১ সালে বাবার মৃতুর সময় ‘রাজাকারের সন্তান’ পরিচয়টি ফাঁস হয়ে গেলে, ফরহাদকে দ্রুত রাজনীতি থেকে সরিয়ে সরকারি অর্থায়নে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপের’ জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিষয়টি ধামাচাপা পরে গেলে ২০২২ সালে দেশে ফিরে তিনি আবার আওয়ামীলীগের প্রোপাগান্ডা সেল-এ সক্রিয় হন।

হাসিনা সরকারের পতনের আগে যে ক’জনের বিরুদ্ধে গণমাধ্যমকে চাপে রাখা এবং আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কটূক্তিকর যুক্তি উপস্থাপন করার অভিযোগ রয়েছে, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ।

ফরহাদ বিভিন্ন সময় কূটনীতিকদের উদ্ধৃতিকে নিজের মনগড়া অপব্যাখ্যা দিয়ে স্যোশাল মিডিয়া, টিভি ও অনলাইন টক শোতে উপস্থাপন করতেন। মাঝে মাঝে এমন তথ্যও তুলে ধরতেন যা শেখ হাসিনার বিশ্বাসের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক হতো। এছাড়াও সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাতের নেতৃত্বে একটি বিশেষ মিডিয়া সমন্বয়ক দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। তার স্ত্রী সাবেক মেয়র আতিকের সাথে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে কর্মরত ছিলেন।

ক্ষমতার শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে দ্রুত সম্পর্ক উন্নয়নে পটু ফরহাদ-তন্ময় জুটির বিরুদ্ধে স্থানীয় আওয়ামী নেতাকর্মীদের সাথে দূর্ব্যবহার করার অভিযোগ উঠে এসেছে। এছাড়া ধানমন্ডির ৬/এ এলাকায় আলাদা অফিস গড়ে তুলে সিআরআইয়ের নাম ভাঙিয়ে গত সংসদ নির্বাচনের সময় নমিনেশন বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।

সিআরআই গুজব সেলের অন্যতম প্রধান তন্ময় আহমেদ একসময় ছাত্রশিবিরের তথ্য বিভাগে কাজ করতেন। পলাশবাড়ি সদরের জামালপুর গ্রামের মানিক সরকারের ছেলে তন্ময় স্কুলে পড়াশোনাকালীন সময়ে জামায়াত ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। সে সময় পলাশবাড়ি ছাত্রশিবিরের তথ্য বিভাগের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। পরবর্তীতে বুয়েটের ছাত্রলীগের নেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে সিআরআইয়ের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেন। এরপর অল্পদিনেই সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও সিআরআইয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য নসরুল হামিদ বিপুর আশ্রয়-প্রশ্রয়ে ফুলেফেঁপে উঠেন। ২০২৩ সালে নসরুল হামিদ বিপু তাকে তিতাস গ্যাস কোম্পানির পরিচালকের পদে বসিয়েছিলেন।

২০২২ সালে ‘মিথ্যা খবর ও বানোয়াট তথ্য’ ছড়ানোর অভিযোগে জার্মানি-ভিত্তিক দ্য কনর্যা ড আডেনাওয়া স্কুল ফর ইয়াং পলিটিশিয়ান (কেসিপ) নামে একটি আন্তর্জাতিক ফেলোশিপ প্রোগ্রাম থেকে তাকে বাদ দেয়া হয়েছিল।

তন্ময় সিআরআই মিডিয়া-উইংয়ের প্রধান হিসেবে পরিচিত হলেও মূলত শেখ পরিবার ও আওয়ামী লীগের সঙ্গে সিআরআইয়ের সমন্বয় করার কাজটি করতেন। সিআরআইয়ের সুসংগঠিত ভুয়া প্রচারণার কাজে অর্থায়ন করা ব্যবসায়ী, আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মী, এমপি-মন্ত্রীদেরও সমন্বয় করতেন তিনি। এছাড়াও বিরোধী মত দমনে তন্ময় গড়ে তুলেন আওয়ামী লীগের গুজব মিডিয়া সেল, যেখানে লাখ লাখ টাকা বেতনে কাজ করতো বিদেশে উচ্চ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একঝাঁক ডিজিটাল এক্সপার্ট। এরাই সমন্বয় করতো স্থানীয়দের সঙ্গে।

এক সূত্র বলেছে, তন্ময়ের উদ্যোগে সিআরআই থেকে দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকদের মাসিক বেতন ও ভাতা প্রদান করা হতো। রক্তাক্ত জুলাইয়েও সিআরআই থেকে বিভিন্ন সাংবাদিকদের মাসিক বেতন প্রদানের একটি তালিকা প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে উঠে এসেছে অনেক সাংবাদিকের নাম। তন্ময়ের নেতৃত্বাধীন মিডিয়া সেল মিডিয়া হাউজগুলোকে যা লিখতে বলত, তারা তাই লিখতে বাধ্য হতো। এছাড়াও তন্ময়ের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিডিয়া মালিকদের সাথে প্রকাশ্যে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে।

সিআরআইয়ের মাধ্যমে আওয়ামী নেরেটিভ প্রতিষ্ঠা এবং তরুণদের ব্রেইন ওয়াশের কাজে প্রচুর অর্থায়ন করা হয়েছে। সিআরআইয়ের সাথে জড়িত এই সুবিধাভোগীরা সেই অর্থ লুটপাট এবং নানা ধরনের দূর্নীতির সাথে জড়িত ছিল। তারা নামে-বেনামে বাংলাদেশের বাইরে নিজেদের অবৈধ সম্পদের পাহাড় বানিয়েছে বলে জানা যায়।

এক অনুসন্ধান থেকে জানা যায়, হাসিনা সরকার পতনের পর দেশ ছেড়ে পালিয়ে ব্যারিস্টার শাহ আলী ফরহাদ ব্যাংককে এবং তন্ময় আহমেদ কলকাতায় লুকিয়ে রয়েছেন। মূলত, সিআরআইয়ের পরিচালনা পর্ষদ বিভিন্ন রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য রাষ্ট্রীয় তহবিলের অপব্যবহার করেছে। গত ৪ ফেব্রুয়ারি সিআরআইয়ের নামে আইএফআইসি ব্যাংকে ৩৫ কোটি ২১ লাখ টাকার ফিক্সড ডিপোজিট রিসিপ্ট (এফডিআর) পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এছাড়াও সোনালী ব্যাংকে লেনদেনের রেকর্ডও পাওয়া গেছে।

এম.কে
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

আরো পড়ুন

যেভাবে নিষিদ্ধ হতে পারে আওয়ামী লীগ

ইভিএমে নয়, ব্যালটে হবে জাতীয় নির্বাচনঃ সিইসি

সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদসহ ৫ জনের নামে মামলা